মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-কেরানীগঞ্জে গণহত্যা হয় কাদের মোল্লার নেতৃত্বে

কেরানীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহম্মেদ খান বলেছেন, কাদের মোল্লার নেতৃত্বে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর (বর্তমানে শহীদনগর) ও কলাতিয়া এলাকায় গণহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। খানবাড়ী এলাকায় হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে ৫৭ জনকে ও ঘাটারচর থেকে শুরু করে বড় ভাওয়ালবাড়ী এলাকায় আরো ২৫ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।
মোজাফ্ফর আহম্মেদ বলেন, 'খানবাড়ী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর লোকেরা আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি ও মোস্তফাকে হত্যা করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা আমাদের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। এসব কথা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি।' তিনি কাদের মোল্লার বিচার দাবি করেন।
একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন মোজাফ্ফর। গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ তিনি এ জবানবন্দি দেন।
এদিকে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১-এ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলায় গতকাল ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে জেরা করেন গোলাম আযমের আইনজীবী। এক প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর মামুন বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সাম্প্রদায়িক ও ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দল।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গতকাল সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন মোজাফ্ফর আহম্মেদ খান। গতকাল তাঁর জবানবন্দি শেষ হলেও আগামী ৮ জুলাই আসামিপক্ষের জেরা করার দিন ধার্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর ও বিচারকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি জবানবন্দি শেষ করেন।
মোজাফ্ফর আহম্মেদ জবানবন্দিতে বলেন, 'আমি ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার পর কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় একটি ক্যাম্প স্থাপন করি। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর ভোরে গুলির আওয়াজ পাই। এরপর আমার ফোর্স নিয়ে কলাতিয়া নাজিরপুর থেকে ঘাটারচরের দিকে যাই। যাওয়ার সময় পথে আমার বাবার সঙ্গে দেখা হয়। বাবা আমাকে দেখে বলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছো? আমি বললাম, ঘাটারচরের দিকে যাচ্ছি। বাবা আমাকে বলেন, আমাদের বাড়িতে ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তুমি ওদিকে যেও না। এ সময় বাবা আমাকে আমার অস্ত্র দিয়ে গুলি না করারও নির্দেশ দেন।' মোজাফ্ফর আরো বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি ও মোস্তফা কলাতিয়া ক্যাম্প থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন। ওই সময় তাঁরা আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যান। আমি আমার বাবার কথা শুনে ওই স্থান থেকে নিরাপদ নিচু জায়গায় আশ্রয় নিলাম এবং বাবাকে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলাম।'
মোজাফ্ফর বলেন, 'আমি যখন খানবাড়ীতে যাই, তখন সেখানে দেখি রক্ত, লাশ আর লাশ। সেখানে হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে মোট ৫৭ জনকে হত্যা করা হয়। ঘাটারচর থেকে খানবাড়ী, খানবাড়ী থেকে বড় ভাওয়ালবাড়ীতে আক্রমণ চালিয়ে ২৫ জনকে হত্যা করে। কিন্তু ওই সময় স্থান ত্যাগ করে রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর লোকেরা চলে গেছে। তখন আমি প্রধান রাস্তা দিয়ে না গিয়ে রাস্তার পেছন দিয়ে ভাওয়ালবাড়ীতে যাই।'
মোজাফ্ফর আরো বলেন, 'আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছদ্মবেশে মোহাম্মদপুর এলাকায় মামার বাসায় যাই। মামার বাড়ি থেকে ফেরার পথে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের সামনে (যেখানে টর্চার সেল ছিল) কাদের মোল্লাকে তাঁর সহযোগীদের নিয়ে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।'
জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে অ্যাডভোকেট একরামুল হক দুটি প্রশ্ন করে মোজাফ্ফরকে জেরা শুরু করেন।
মোজাফ্ফর আহম্মেদ খান ওসমান গনি ও গোলাম মোস্তফা নিহত হওয়ার ঘটনা বর্ণনাকালে বিচারক মো. শাহিনুর ইসলাম বলেন, 'ওসমান গনি ও গোলাম মোস্তফা কিভাবে নিহত হন, তা আগে ক্লিয়ার করেন, এরপর অন্য কথা বলেন।' তখন সাক্ষী মোজাফ্ফর খান বলেন, 'আমার বাবার সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনা বলি এরপর বলব।' এ পর্যায়ে বিচারক মো. শাহিনুর ইসলাম আবার বলেন, 'ওই লাইনটা ক্লিয়ার হচ্ছে না।' তখন সাক্ষী মোজাফ্ফর উত্তেজিত হয়ে পড়েন। প্রসিকিউটর ও ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, 'আমাকে কেন চার্জ করছেন, সাক্ষী দেব না। আমাকে বলার সুযোগ না দিলে সাক্ষী দেব না। আপনারা যা খুশি করেন। আমাকে চার্জ করে আপনারা আইন লঙ্ঘন করেছেন।' এরপর তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, 'আমি হাইব্রিড নই। আমি জেনুইন মুক্তিযোদ্ধা। বহু হাইব্রিড মুক্তিযোদ্ধা আমি দেখেছি। আমি পেইড সাক্ষী নই। আমি স্ব্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছি।' এ পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বিচারকরা চুপ করে বসে থাকেন।
চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ প্রসিকিউটররা সাক্ষীকে বোঝাতে সক্ষম হলে আবার সাক্ষ্য দিতে রাজি হন।
গোলাম আযমের দল ধর্ম ব্যবসায়ী
ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলায় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে জেরা করেন গোলাম আযমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম। তিনি জানতে চান জামায়াতে ইসলামীকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দল মনে করেন কিনা? 'জবাবে মুনতাসীর মামুন বলেন, 'সাম্প্রদায়িক ও ধর্ম ব্যবসায়ী দল মনে করি।' ১৯৪৬ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন কি না- প্রশ্নের জবাবে মুনতাসীর মামুন বলেন, 'মুসলিম লীগ করতেন।'

No comments

Powered by Blogger.