জঙ্গিবাদী, মুনাফামুখী এনজিও চিহ্নিত করতে কমিশন হচ্ছে by আশরাফুল হক রাজীব

জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত বিভিন্ন এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার শ্বেতপত্র প্রকাশ করার কথা ভাবছে সরকার। সমাজসেবার নামে যারা অবৈধভাবে ব্যবসায় লিপ্ত রয়েছে, তাদের নামও শ্বেতপত্রে রাখা হতে পারে। এ জন্য অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।


কমিশন অনুমোদনের জন্য শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এ জন্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন প্রয়োজন। শিগগিরই তা মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। কমিশনের কাজ হবে বর্তমানে কর্মরত এনজিওগুলোর অবস্থা তুলে ধরা। পুরোপুরি শ্বেতপত্র না হলেও এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো কী করছে, কিভাবে করছে- তার বিস্তারিত বর্ণনা কমিশনের প্রতিবেদনে থাকবে। একই সঙ্গে তারা এনজিও-সংক্রান্ত একটি সমন্বিত আইনের খসড়া প্রস্তুত করবে। এর ওপর ভিত্তি করেই পরে আইন প্রণয়ন করা হবে।
এনজিও নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন প্রণয়নে সরকারের ইচ্ছা থাকার পরও প্রভাবশালীদের চাপে গত সাড়ে তিন বছরে নতুন আইন প্রণয়ন হয়নি।
এনজিও খাতের এ বিশৃঙ্খলা বন্ধের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে সব এনজিওকে কড়া নজরদারির মধ্যে আনার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু প্রভাবশালী কিছু এনজিও সরকারের ওপর চাপ দিয়ে আইন প্রণয়নে বাধার সৃষ্টি করে। পরে খসড়া আইনটি পাঠানো হয় প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায়। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর গত মাসে আইন প্রণয়নের জন্য কমিশন গঠনের বিষয়ে অনুমোদন দেয় এ কমিটি। এর আগে অর্থবিভাগ স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা ও এনজিওগুলোর নিবন্ধন-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ তত্ত্বাবধানের বিধান করে আইন প্রণয়নে আপত্তি জানায়। অর্থবিভাগ তাদের আপত্তিপত্রে উল্লেখ করে, 'সামাজিক সংস্থা নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি কমিশন গঠন করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন করতে পারে।' এর পরই কমিশন গঠন করার তোড়জোড় শুরু হয়।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সমাজক্যাল্যাণ সংস্থাগুলোর নিবন্ধন আইন সংস্কার কমিশন, ২০১২-এর কার্যপরিধি ও ১১ জন সদস্যের পদ-পদবী চূড়ান্ত করা হয়েছে। কমিশন গঠন করা হবে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে। তবে প্রয়োজনে একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিবের নেতৃত্বও কমিশন হতে পারে। খসড়া আইন প্রণয়নের জন্য একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত কমিশনে। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থার একজন প্রতিনিধি, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের প্রতিনিধি, আইন বিভাগের প্রতিনিধি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি খণ্ডকালীন সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। ছয় মাস মেয়াদী কমিশনের সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন একজন যুগ্ম সচিব।
কমিশন দেশি-বিদেশি সাহায্য, অনুদান, ঋণ নেওয়া ও হিসাব দেওয়ার পদ্ধতি নির্ধারণ করবে। স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলোর (রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা ও সমাধানের উপায়ও নির্ধারণ করবে কমিশন।
বর্তমানে এনজিও খাতে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। প্রায় আড়াই লাখ নিবন্ধিত এনজিওর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। সরকারের নানা সংস্থা থেকে নিবন্ধন নিয়ে তারা ইচ্ছামতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনেক এনজিওর বিরুদ্ধে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনেও তাদের ইন্ধন রয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। সমাজসেবার নামে তারা পুরোদমে ব্যবসা করছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, সব সরকারের আমলেই এনজিও নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের কাজ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। কারণ এনজিওগুলোর নেপথ্যে রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। বিএনপি-জামায়াত ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ও এনজিও নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে। তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করা হয়েছি। কমিটির দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যায়নি। সেখানেও এনজিও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত আইনের কথা বলা হয়েছিল।
২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর টিআইবির তত্ত্বাবধানে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। টিআইবির তৎকালীন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সমন্বিত আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা কালের কণ্ঠকে বলেন, আইনটির পক্ষে যেমন জনমত আছে, তেমনি আইনটি না করার পক্ষের লোকেরও অভাব নেই।
জানা গেছে, বর্তমানে এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিবন্ধিত হয় ছয়টি আইনে। আইনগুলো হচ্ছে- ১৮৬৫ সালের সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট অ্যাক্ট, ১৯৬১ সালের স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৭৮ সালের ফরেন ডোনেশন (ভলানটারি একটিভিটিজ) রেগুলেশন অর্ডিনেন্স, ১৯৮২ সালের ফরেন কন্ট্রিবিউশন (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স এবং ২০০৬ সালের মাইক্রো রেগুলেটরি অথরিটি আইন। এসব আইনের অধীনে এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নিবন্ধন দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো, জয়েন্ট স্টক কম্পানি, মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি ও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর।

No comments

Powered by Blogger.