প্রতিক্রিয়া-খোলা চিঠির উত্তরে by মুহাম্মদ মুসা খান

বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সমালোচনা হলে তার জন্য ড. ইউনূসকে দায়ী করা অনেকের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কোনো অনিয়ম সংঘটিত হলে তার সমালোচনা দেশে যেমন হয়, বিদেশেও হয়। কাজেই এসব সমালোচনা সবাইকে সহ্য করতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে জনাব চৌধুরীর আশঙ্কা অমূলক নয়।


গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের তুলনায় একটি খুবই ক্ষুদ্র ইস্যু

সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ৯ জুন সমকালে প্রকাশিত 'ড. ইউনূসের কাছে একটি খোলা চিঠি' পড়ে মনে হয়েছে তিনি 'গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ : আমার শঙ্কা' শীর্ষক প্রবন্ধটি (৩১ মে) মনোযোগ দিয়ে পড়েননি অথবা ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছেন। ড. ইউনূস যেসব বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেগুলো নিয়ে মতামত জানতে পারলে পাঠকরা খুশি হতেন বলে মনে হয়।
ড. ইউনূস তার প্রবন্ধে কোথাও বলেননি তদন্ত কমিশন গঠন করায় তিনি শঙ্কিত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'গ্রামীণ ব্যাংক দেশে কী অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে যে তার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে? বিনা কারণে তদন্ত কমিশন গঠন করার অর্থ জোর করে অনিয়ম বের করা নয় কি?'
ড. ইউনূসের প্রবন্ধ পড়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের আয়-ব্যয় বা তার নেতৃত্ব নিয়ে তদন্ত করলে শঙ্কিত হতেন না। কারণ সেই আয়-ব্যয়ের পর্যালোচনা তো বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতেই রয়েছে। আর সুদের হার বা ব্যাংক পরিচালনায় অন্য ঘটনাবলি নিয়েও শঙ্কার কারণ নেই। সরকার গঠিত আগের তদন্ত কমিশন মতামত দিয়েছিল : 'গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার বাংলাদেশে সর্বনিম্ন।'
জনাব চৌধুরী কমিশনের কার্যপরিধি ভালো করে হয়তো পড়েননি। এর একটি হলো 'গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা বিন্যাস ও বোর্ড প্রতিনিধিত্ব, বোর্ড সদস্যদের যোগ্যতা নির্ধারণ সম্পর্কে তাদের মতামত দেওয়া।'
ড. ইউনূস এ পয়েন্টেই তার শঙ্কা প্রকাশ করে এ ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা তার ঋণগ্রহীতাদের হাতে। ৯৭% মালিক তারাই। আর ৩% সরকারের। ড. ইউনূসের আশঙ্কা, সরকার আইন পরির্বতন করে এই মালিকানা প্যাটার্ন পাল্টে এটি সরকারি ব্যাংক করে ফেলতে পারে। গরিবের মালিকানার এ ব্যাংক 'সরকারি ব্যাংক' হয়ে গেলে গ্রামীণ ব্যাংক তার ব্যতিক্রর্মী ও অনন্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলতে পারে। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা দেখেই তার এ আশঙ্কা হয়তো।
গ্রামীণ ব্যাংক ৩৪ বছর ধরে পরিচালনা করে ড. ইউনূস যদি তহবিল তছরূপ করে থাকেন বা আরও নানা অপকর্ম করে থাকেন বা ব্যাংকের মুনাফা পকেটস্থ করে থাকেন তদন্ত কমিশন তা নিশ্চয় উদ্ঘাটন করবেন (কার্যপরিধির 'ক' দ্রষ্টব্য)। জনাব গাফ্ফার চৌধুরীর কি মনে হয় ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক যুগ্মভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধু চেহারা দেখিয়ে বা ঘুষ দিয়ে পেয়েছেন? ম্যাগসাইসাইসহ পৃথিবীর আরও অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার ড. ইউনূস কি তদবিরের জোরে পেয়েছেন? ড. ইউনূস তার শঙ্কার কথা শুধু দেশের পত্রিকায় লিখে জানিয়েছেন। বিদেশি মিডিয়া তা হয়তো উদ্ধৃত করেছে। তদন্ত নিয়ে ড. ইউনূস কোনো আপত্তি জানাননি। তিনি শুধু বলেছেন, 'এতে তার মন খারাপ হয়েছে।' মন খারাপ হওয়ারই তো কথা। কারণ যে ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, যে ব্যাংক তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য সারাবিশ্বে সমাদৃত, বর্তমান সরকার সেই ব্যাংক নিয়ে 'যুবক' বা 'ডেসটিনির' মতো আচরণ করছে।
জনাব গাফ্ফার চৌধুরী ৩৪ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের নানা অনিয়মের তদন্তের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ৩৪ বছর ধরে 'বাংলাদেশ ব্যাংক' ও বহিরাগত অডিট টিম তাহলে কী অডিট করল? এখন যদি নানা অনিয়ম উন্মোচিত হয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমও কি সে জন্য দায়ী হবে না?
'গ্রামীণ' নামক কোম্পানিগুলোর সম্পর্কে বলা যায়, 'গ্রামীণ ব্যাংক' এই ৫৪ কোম্পানির অংশ নয়। এটি একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতারা এ ব্যাংকের মালিক। তারা মুনাফার অংশ পায়। তাদের সঞ্চয়ের টাকাই এ ব্যাংকের মূলধন। ড. ইউনূস 'আইন অনুসারে এদের কোনো মালিক নেই' বাক্যটি লিখেছেন গ্রামীণ শব্দ যুক্ত কোম্পানিগুলো সম্পর্কে। গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে নয়। মনোযোগ দিয়ে না পড়লে এ রকম বিভ্রান্তি হতেই পারে।
বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সমালোচনা হলে তার জন্য ড. ইউনূসকে দায়ী করা অনেকের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কোনো অনিয়ম সংঘটিত হলে তার সমালোচনা দেশে যেমন হয়, বিদেশেও হয়। কাজেই এসব সমালোচনা সবাইকে সহ্য করতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে জনাব চৌধুরীর আশঙ্কা অমূলক নয়। গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের তুলনায় একটি খুবই ক্ষুদ্র ইস্যু।
হিলারি ক্লিনটনের সাম্প্রতিক চিঠি নিয়েও গাফ্ফার চৌধুরী বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মিসেস ক্লিনটন চিঠিতে আশা প্রকাশ করেছেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের অখণ্ডতা যেন রক্ষা পায়।' তিনি 'গ্রামীণ' নামক কোম্পানিগুলোর তদন্তে 'স্বচ্ছতা' থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকে ড. ইউনূস তার কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কোথায় দাবি করেছেন? তার প্রবন্ধের কোথাও কি সে কথা আছে? ড. ইউনূস ব্যাংকের ৯০ লাখ ঋণগ্রহীতার কর্তৃত্ব খর্ব না করে বরং শক্তিশালী করার দাবি তুলেছেন। আমরা দেখেছি যে বিদেশি জ্ঞানী-গুণী মানুষদের অনুরোধ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সরকার, আদালত, বাংলাদেশ ব্যাংক সবাই স্বাধীনভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সম্পর্কে সিদ্ধান্ত বা রায় দিয়েছেন। এতে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপ ছিল বলে শুনিনি। বিদেশের কয়েকজন নেতা সরকারের নানা সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মাত্র। 'উদ্বেগ প্রকাশ' আর 'হস্তক্ষেপ' কি এক?
বাংলাদেশের ৯০ লাখ গরিব মহিলার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক। তাদের ব্যাংক যদি সরকারি হস্তক্ষেপে নষ্ট হয় তাহলে এর জন্য নিশ্চয়ই একদিন দেশের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে ।

মুহাম্মদ মুসা খান :বেসরকারি
প্রতিষ্ঠানে কর্মরত
mkhanctgbd@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.