শরণার্থী-বিশ্ব সম্প্রদায় কি রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে না? by আবু সাঈদ খান

এ কথা সত্য, বিষয়টি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। মিয়ানমারকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে সেখানে একটি জনগোষ্ঠীর মানবিক বিপর্যয়ে বিশ্ব বিবেক নীরব থাকতে পারে না। ধর্মীয় ও জাতিগত ভিন্নতার কারণে একটি জনগোষ্ঠী স্বদেশে পরবাসী হবে, তা কি বিশ্বের সচেতন রাষ্ট্র ও জনগণ মেনে নেবে?


জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা যেখানে উপেক্ষিত, সেখানে বিশ্ব সমাজ তার বিহিত কি করবে না? কোন যুক্তিতে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিপীড়িত হতে থাকবে? এ ব্যাপারে মিয়ানমারের আধা সামরিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা বিশ্ব সমাজের কর্তব্য

টেলিভিশনের পর্দায় নাফ নদী দিয়ে ছুটে আসা সাম্পানগুলোতে দেখছি মিয়ানমার থেকে তাড়া খাওয়া নর-নারী-শিশুর ভয়ার্ত মুখগুলো। তাদের করুণ আকুতি শুনছি আমরা। এবার বাংলাদেশে তাদের আশ্রয় মিলছে না। সাম্পানে কিছু খাবার ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে স্বদেশে ফিরে দেওয়া হচ্ছে তাদের। কিন্তু কোথায় তাদের দেশ? মিয়ানমারে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে বাস করেও সেখানে আজ তারা পরবাসী। দরিয়ায় সাম্পানে ভাসার চেয়ে কঠিন, ভয়বিহ্বল হয়ে উঠেছে মিয়ানমারে বসবাস। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত কয়েক দিনে ২৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। ২৫ হাজার বাড়ি পুড়েছে, আর গৃহ ছেড়েছে ৩০ হাজার মানুষ। মিয়ানমারের ভেতরে-বাইরে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাস্তবতা এর চেয়ে ভয়াবহ। কেননা, সংবাদ প্রকাশ এমনকি সংগ্রহের ক্ষেত্রে মিয়ানমারে রয়েছে সরকারি নানা বাধানিষেধ।
ছিন্নমূল এই মানুষগুলো নৃতাত্তি্বক পরিচয়ে রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে ১৩০টি নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গারা নেই। তাদের সেখানে বলা হচ্ছে বাঙালি। এটি সত্য যে, বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যাওয়া জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার তারা। মধ্যযুগেও রাষ্ট্রের সীমান্তে প্রহরা ছিল না। এক এলাকা থেকে জনস্রোত আরেক এলাকায় আছড়ে পড়েছে। রাখাইন রাজ্য থেকে মানুষ চট্টগ্রামের আশপাশে নিবাস গড়েছে। আবার চট্টগ্রাম বা উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নর-নারী সেখানে বসতি স্থাপন করেছে। একদা পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ওই অঞ্চলের স্বাধীন রাজ্য আরাকান ছিল হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মিলনভূমি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল আরাকান রাজসভার। কবি আশরাফ খান ছিলেন রাজা থাদোমেন্তরের (১৬৪৫-৫২) যুদ্ধমন্ত্রী। বাংলা ভাষার কবি আলাওল আরাকানের প্রধান অমাত্য কোরেশী মাগন ঠাকুরের আনুকূল্যে আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। কিন্তু বহুত্ববাদী সমাজের বাস্তবতাকে এড়িয়ে রাখাইন রাজ্যকে কেবল বৌদ্ধ রাজ্য করার মানসিকতা আজকের সৃষ্ট সংকটের মূল কারণ, যা মহামতি বুদ্ধের জীবন দর্শনের পরিপন্থী।
রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা নতুন নয়। ১৯৪২ সালে সৃষ্ট দাঙ্গায় অনেক রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম এসে আশ্রয় নেয়। ১৯৪৮ সালে উ-নুর শাসনামলে বার্মা টেরিটোরিয়াল ফোর্স (বিটিএফ) রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখলের পর সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে সংকট তীব্র হয়। ১৯৭৮ সালে নাগাসিন ড্রাগন অপারেশনের ফলে দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশে বাধ্য হয়। পরে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হলেও আবার ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে নেয় মিয়ানমার। তবে টেকনাফ ও উখিয়া ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা এখনও অবস্থান করছে। তালিকার বাইরে আরও এক লাখ শরণার্থী। ধারণা করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিন-চার লাখ রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম ও আশপাশের জনস্রোতে মিশে গেছে। অনেকেই পাড়ি জমিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে।
১৯৮২ সালে নতুন নাগরিকত্ব আইনে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে গণ্য করায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। অনুমতি ছাড়া তারা বিয়ে করতে কিংবা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে পারে না। এমনকি বিভিন্ন অজুহাতে তাদের জমিও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের ভেদনীতিতে ৮ লাখ রোহিঙ্গার জীবন আজ দুর্বিষহ। তারা তাড়া খেয়ে ফিরছে, পতিত হচ্ছে মানবেতর জীবনে।
অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তাদের কয়েক দফা আশ্রয় দিয়েছে, যা এখানে অনেক সংকটের জন্মও দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ড্রাগ ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত। বাংলাদেশের পাসপোর্টে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সেখানে অপরাধ কর্মে জড়িয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। জঙ্গি কানেকশনের অভিযোগ রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। এ যুক্তি দেখিয়ে অনেকে বলছেন, বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে কেন সমস্যা বাড়াবে?
এ কথা সত্য, বিষয়টি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। মিয়ানমারকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তবে সেখানে একটি জনগোষ্ঠীর মানবিক বিপর্যয়ে বিশ্ব বিবেক নীরব থাকতে পারে না। ধর্মীয় ও জাতিগত ভিন্নতার কারণে একটি জনগোষ্ঠী স্বদেশে পরবাসী হবে, তা কি বিশ্বের সচেতন রাষ্ট্র ও জনগণ মেনে নেবে? জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা যেখানে উপেক্ষিত, সেখানে বিশ্ব সমাজ তার বিহিত কি করবে না? কোন যুক্তিতে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিপীড়িত হতে থাকবে? এ ব্যাপারে মিয়ানমারের আধা সামরিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা বিশ্ব সমাজের কর্তব্য।
সঙ্গত কারণেই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা রয়েছে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের নেত্রী অং সান সু চির প্রতি। আমরা জানতে চাই, তার গণতন্ত্র কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখবে, না সংখ্যালঘিষ্ঠের অধিকারও নিশ্চিত করবে।
বর্তমানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গণতন্ত্রের অভিযাত্রার পথে যে একটি অশুভ সংকেত তা বলাবাহুল্য। আমরা জানি, সামরিক জান্তা বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে হানাহানি বাধিয়ে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এটি এমনই কোনো প্রয়াস কি-না তা খতিয়ে দেখা উচিত। আজ যে খৰ রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে এসেছে, সেই খৰ আগামীকাল অন্য জাতির ওপর উত্তোলিত হতে পারে। উপমহাদেশীয় বংশোদ্ভূত অন্যান্য জনগোষ্ঠী এর শিকার হতে পারে, যা হয়ে দাঁড়াবে মিয়ানমারের সংহতি ও গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি।
মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বন্ধনে আমরা আবদ্ধ। আমরা মিয়ানমারের শান্তি ও কল্যাণ চাই। তাই তো যখন অং সান সু চির ওপর নির্যাতন নেমেছে, তখন বাংলাদেশের সচেতন মানুষ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ অঞ্চলের উন্নতির স্বপ্ন যখন দেখি, তখন মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি না। বাংলাদেশ অবস্থানগত কারণে যেমনি দক্ষিণ এশিয়ার, তেমনি পূর্ব এশিয়ারও। আজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জেগে উঠছে। নতুন জাগরণ এসেছে এশিয়ায়। সেই জাগরণকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের মাঝে সৌহার্দ্যের বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। এর মানে কি এই যে, মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটবে, সেখান থেকে অসহায় নর-নারী বারবার এসে আশ্রয় চাইবে আর আমরা বন্ধুত্বের খাতিরে নীরব থাকব? তা হতে পারে না। রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা বাংলাদেশের দায়িত্ব। ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বড় অংশ আমরা সে দেশকে নিতে বাধ্য করলেও রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করতে পারিনি। এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের কূটনীতিতে বরাবরই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সরকার প্রতিবেশীর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে রাজি নয়। তাদের ধারণা, বোঝাপড়া বা দরকষাকষি করলে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়। অথচ দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের প্রয়োজনেই তা দরকার।
১৯৭৮ বা ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসী ততটা ওয়াকিবহাল ছিল না, এখন অবস্থা খানিকটা বদলেছে। বিষয়টি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নজরে রয়েছে। যে কারণে এবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়দানের কথা বলা হচ্ছে ইউএনএইচসিআরসহ নানা মহল থেকে। এখন বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্বকে বোঝানো যে, এটি কেবল উদ্বাস্তু সমস্যা নয়, বিষয়টির রাজনৈতিক-সামাজিক তাৎপর্যও রয়েছে। তাই মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য বাধ্য করতে হবে। আর সে কাজ করতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই। যুক্তিগ্রাহ্য কারণেই বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী হতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে_ কেবল চাপ সৃষ্টি কি যথেষ্ট? যারা তাড়া খেয়ে আসছে, তাদের কি আমরা ফিরিয়ে দিতে থাকব? আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতি সতর্ক থেকে তাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা কি আমরা ভাবতে পারি না? মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায় অনেক বড়। ৪১ বছর আগে যে দেশের এক কোটি নাগরিক প্রতিবেশী ভারতে শরণার্থী হয়ে গিয়েছিল, সেই দেশ কীভাবে নিজ সীমান্ত থেকে অসহায় নর-নারী-শিশুকে বিদায় দেবে_ সেটি মানবিক প্রশ্ন।
ধরা যাক, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আর আশ্রয় মিলল না। কিন্তু অন্য পথে তাদের প্রবেশ কি ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে? গোপন পথে এসে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রাম ও আশপাশের জনস্রোতে মিশে গেলে সেটি বাংলাদেশের জন্য হবে আরও বিপজ্জনক। বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টির পরিচয় দিতে হবে; সেটি হতে পারে বাংলাদেশের জন্য খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও জাতীয় অঙ্গীকারের বিষয়টি জড়িত।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.