গন্তব্য ঢাকা-নতুন দিনের প্রতীক্ষা by শর্মিলা সিনড্রেলা

মা বা বাবার কোনো একজন যদি কাছছাড়া হয়ে যান, তবে তার শাস্তি বেশির ভাগই ভোগ করতে হয় সন্তানদের। কেউ যদি ভাগ্যক্রমে একটু ভালোও থাকে, তবু বেশির ভাগেরই দিন কাটাতে হয় পথেঘাটে। অনাদর আর অবহেলায় তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বাগেরহাটের চিতলমারী থানার উমাজুরি গ্রামের ছেলেটিও এর বাইরে নয়।


নিয়তির অবহেলায় মাত্র এক বছর বয়সে বাবাকে হারায়। তারপর? নতুন কষ্টময় এক রাজ্যের দিকে পথচলা শুরু।
তার নাম আলী আকবর। বাংলাদেশের অনেক খেটে খাওয়া মানুষের একজন। কোনো এক ক্লান্ত বিকেলে সতেজতা আনতে অথবা ছুটির দিনটাকে মধুর করে তুলতে যদি পা বাড়ান আহসান মঞ্জিলের পথে, তাহলে দেখবেন, আহসান মঞ্জিলের গেটের কাছেই রকমারি ফল নিয়ে বসে আছেন প্রায় ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। কখনো যদি কাউকে আমড়া কেটে দিচ্ছেন, তো আরেকজনকে মাখিয়ে দিচ্ছেন জাম্বুরা। এতে যে তাঁর কষ্ট একেবারেই হচ্ছে না, তা নয়। তবে আনন্দ হচ্ছে এটুকুই যে, খাওয়া শেষে প্রত্যেকেই তাঁকে খাবারের যথার্থ দাম দিয়ে যাচ্ছে। আর এ দাম দিয়েই তো তিনি তাঁর সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করেন।
বাবা-মা আর এক ছেলে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কল্পনা করলে বেশ সুখের সংসার। কিন্তু যদি কারও কপালে সুখ না সয়, তবে! তেমনই হয়েছে আলী আকবরের জীবনে। মাত্র এক বছর বয়সে বাবা গেলেন পরপারে। নিজেদের জমি-বাড়ি সব ফেলে রেখে মা চলে এলেন সন্তানকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে। অভাব-অনটনে দিন হয়তো চলে যেত। কিন্তু শনির দৃষ্টি যার ওপর পড়ে, তার কি আর পালানোর পথ থাকে? তাই কয়েক বছর যেতে না-যেতেই পারিপার্শ্বিক চাপে মাকে আবার বসতে হলো বিয়ের পিঁড়িতে। ফলাফল, আলী আকবরের জ্বলন্ত কড়াইয়ে পড়া। নতুন সংসার, নতুন স্বামী নিয়ে মায়ের ব্যস্ততা দিন দিন বেড়েই চলে। আর আকবর পড়ে থাকেন রাস্তাতেই। আদর-স্নেহ-ভালোবাসা কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
নিজের কথা বলার ইচ্ছা তাঁর অবিরাম। কষ্টগুলো বুকে চেপে রাখতে রাখতে এখন মুখ খুলে কিছু বলতে ইচ্ছা করে হয়তো। বলে চলেন তিনি নিজের মতো, ‘মা যখন আবার বিয়া করছে, তখন কিছুদিন খুব ভালো ছিলাম। কিছুদিন পর মা আর আমাকে তেমন আদর করত না। আমার যখন আর এক ভাই ও বোন হলো, তখন আর মায়ের সাথে দেখাই হতো না। আমি তখন কখনো কারও বাড়িতে, আবার কখনো বা রাস্তায় থাকতাম। খেতাম যেখানে ভাগ্যে মিলত। তখন অনেক কষ্ট করছি। কখনো কখনো না খেয়েও থাকছি। রিকশাও চালাইছি। খুব কষ্ট রিকশা চালানো। কিন্তু কী আর করব! গ্রামে কষ্টে থাকতাম, তাও ভালোই লাগত। নদী, পানি, বাতাস সবই ভালো। আবার আমার বন্ধুবান্ধবও ছিল। কিন্তু কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমার এক বন্ধুকে বললাম, “আমাকে ঢাকায় নিয়ে চল।” সেই আসা আমার এই শহরে।’
‘ঢাকায় আইছি আজ প্রায় ২৫ বছর। এর ১৫ বছর পর বিয়া করছি বরিশালের লাইজু বেগমকে। এখন আমাগো তিন মেয়ে আর এক ছেলে। বাবা ছিল না বলে আমার পড়াশোনাটা হয়নি। এখন কষ্ট হয়। যদি পড়াশোনাটা করতাম, তাহলে অন্যরা যেমন চিঠি লেখে ও পড়ে, তেমন আমিও পড়তে পারতাম। আমার ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষককে দিই ৩০০ টাকা। পড়ালেখা জানলে নিজেই পড়াতে পারতাম। বড় মেয়েটার নাম আঁখি। টাকা-পয়সার অভাব বলে ওর তো এই ১২ বছর বয়সেই দর্জির কাম শুরু করতে হইছে। ছোট তিনটারে তো পড়াইতে চাই।’
বলে চলেন আলী আকবর নিজের মতো করে, ‘এই ব্যবসা করি আজ প্রায় দুই বছর ধরে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকি এখানেই। কিন্তু খরচে আর কুলাইতে পারি না। মনে করেন, এই ব্যবসা করে লাভ হয় প্রায় দেড় শ, দুই শ টাকা। কষ্ট হয় সংসার চালাইতে, তাই বউ আর মেয়েটা কাজ করে। আবার গ্রামে যে যাব, তাও তো হবে না। ওখানে তো কিছু নাই। দ্বিতীয় বাবাও নেই। বাবা মরার পর মা খোঁজখবর নিত। এক বছর হলো মাও মারা গেছে। আমাদের যেটুকু জায়গা-জমি ছিল, তা অন্য লোকে নিয়ে নিছে। আর কোথায় যাব, গ্রামে? তবে এখনো মামাদের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়া হয়। আমি তো সবকিছুই হারাইছি। কেউ থাকলে নাইলে গ্রামে গেলে ভালো লাগত। এখন এই ঢাকাতেই থাকতে হবে।’ এ রকমই অব্যক্ত সব কষ্ট বুকে চেপে আলী আকবর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েন আমড়া কাটতে। প্রতিদিনই সকাল ১০টায় এসে শুরু করেন বিক্রির কাজ। চলে ততক্ষণ, যতক্ষণ না আহসান মঞ্জিলে দর্শনার্থীদের আনাগোনা শেষ হয়। আর অপেক্ষা করেন একটা নতুন দিনের। কে জানে, যদি নতুন কোনো বার্তা বা দিনবদলের ডাক দিয়ে যায় আগামী দিনটি!

No comments

Powered by Blogger.