শ্রমিক অসন্তোষ-পোশাকশিল্প খাতে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে by এম এম আকাশ

পোশাকশিল্প খাতে মনে হচ্ছে যেন ‘গন্ডগোল’ কিছুটা কমেছে। ন্যূনতম মজুরির দাবিতে, ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে, রেশনের দাবিতে, মুনাফার অংশীদারের দাবিতে, যথাসময়ে বেতন প্রদানের দাবি ছাড়াও আরও অনেক দাবিতে সারা দেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা সম্প্রতি একটি বীরত্বপূর্ণ লড়াই শেষ করেছেন।


এ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাত্রা হাজারে সীমাবদ্ধ থাকেনি, লাখ লাখ শ্রমিক এতে অংশ নিয়েছিলেন। আন্দোলন এত স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কিছু কিছু ভাঙচুর, সড়ক অবরোধের মতো বিশৃঙ্খল ঘটনাও সংঘটিত হয়েছিল।
এই আন্দোলনে শ্রমিকপক্ষের নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। মালিকপক্ষ প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিলেন, ন্যূনতম মজুরি ৪০ শতাংশের বেশি হারে বৃদ্ধি করলে এবং সেই অনুপাতে অন্য গ্রেডের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করলে তাঁরা কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। শ্রমিকেরা বলেছিলেন, বর্তমান বাজারদরে পাঁচ হাজার টাকার কম মাসিক মজুরিতে একজন শ্রমিকের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই অসম্ভব। এই দুই পক্ষের মাঝামাঝি সরকার একটি আপসরফার চেষ্টা করে। সরকার ন্যূনতম বেতন ১০০ শতাংশ (প্রায়) বৃদ্ধি করে তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে। অন্য সব গ্রেডে বেতন ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ বৃদ্ধির নোটিশ প্রদান করে। এতে সবচেয়ে নিচের শ্রমিকেরা অর্থাৎ ‘হেলপাররা’ খুশি হলেও ওপরের গ্রেডের সচেতন শ্রমিকেরা মোটেও খুশি হননি। তাঁদের খুশি না হওয়ার কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. যেহেতু এই বর্ধিত বেতন ঈদের পরে নভেম্বর মাস থেকে কার্যকর হওয়ার কথা, সেহেতু সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে তাঁরা পুরোনো হারেই উৎসব-ভাতা পাবেন অথচ তাঁরা আশা করেছিলেন যে তাদের ন্যূনতম বর্ধিত বেতনটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হলে এবারের ঈদেই তাঁরা বর্ধিত এক মাসের বেতনের সমান বোনাস পেতে পারতেন। সেটা না পাওয়ায় তাঁদের আশা ভঙ্গ হয়েছে। রোজার ঈদের আনন্দ মাটি হয়েছে। তবে ১ নভেম্বর থেকে বর্ধিত বেতন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কার্যকর না হলে এবং তদনুযায়ী বোনাস প্রদান না করলে আসন্ন কোরবানি ঈদের আনন্দটুকুও তাঁদের মাটি হয়ে যাবে। এই আশঙ্কায় এবার তাঁরা অস্থির ও বিক্ষুব্ধ। তাঁদের চাপা ক্ষোভ, ‘একবার আমরা প্রতারিত হয়েছি, এবার আমরা দ্বিতীয়বার কিছুতেই প্রতারিত হব না।’ তাই আগামী নভেম্বর মাসে সরকার ও মালিকপক্ষ উভয়কেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।
২. এবার মালিকপক্ষের সামনে রয়েছে ‘এসিড টেস্ট’। প্রশ্নটি হচ্ছে, বেতন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তাদের প্রকৃতপক্ষে কতটুকু ক্ষতি হবে। তাদের কি এতই ক্ষতি হবে যে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তরটি খুব সহজেই বোঝা সম্ভব। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে যদি উৎপাদিত পোশাকের দাম বৃদ্ধি না পায়, অন্যান্য খরচ যদি আগের মতোই থাকে, তাহলে মজুরি বৃদ্ধি পেলে সেই মাত্রায় মালিকদের মুনাফা কমে যেতে বাধ্য। কিন্তু মুনাফা কমলে মালিকদের পেটে টান পড়বে কি? এ কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে এতে তাদের অন্তত পেটে টান পড়বে না, বড়জোর তাদের বিলাসের মাত্রা কিছুটা কমাতে হতে পারে এবং নতুন নতুন বিনিয়োগ করে সঞ্চিত সম্পদ বৃদ্ধির গতিবেগ কিছুটা শ্লথ হতে পারে। আর যদি বর্ধিত বেতনের কারণে নতুনভাবে শ্রমিকদের শৃঙ্খলা ও উৎপাদন কিছুটা বৃদ্ধি পায়, তাহলে এই ঘাটতিটুকুও মালিকদের হবে না।
যা হোক, বেতন বৃদ্ধির পর আগামী ছয় মাসে কয়টি পোশাক কারখানা বন্ধ হলো এবং কয়টি নতুন তৈরি হলো, তা হিসাব করে বের করা মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়। তবে এই প্রকৃত হিসাবটা ‘সরকার’ বা ‘তৃতীয়’ কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে হিসাব করে বের করার দায়িত্ব নিতে হবে। বিজিএমইএ বা স্কপকে এই দায়িত্ব না দেওয়াই সমীচীন হবে। মনে রাখতে হবে, এই তথ্যের ব্যাপারে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ উভয়ে খুবই সংবেদনশীল।
কিন্তু দেশের স্বার্থে শুধু শ্রমিক বা মালিক নন, দেশের সব নাগরিকই জানতে চায় পোশাকশিল্পের বাস্তব অবস্থাটা কী? কেন অন্য দেশ বেশি মজুরি দিয়ে বিশ্ববাজারে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে পারলেও বাংলাদেশ পারছে না? এ জন্য কে দায়ী, দেশবাসী তা জানতে চায়। খরচ বেশি (কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ পরিবহন ইত্যাদি) নাকি বিদেশিরা বাংলাদেশি মালিকদের কম দাম দিচ্ছেন সে জন্য, নাকি মালিকদের অনেক অদৃশ্য খরচ রয়েছে (যেমন—ঘুষ, স্পিড মানি, ঋণের ওপর বর্ধিত সুদের হার ইত্যাদি), নাকি আসলে কোনোই সংকট নেই, মালিকেরা মিথ্যা বলছেন। পোশাকশিল্পের এসব তথ্যগত স্বচ্ছতা বিধানের জন্য ব্যালেন্স শিট প্রকাশ করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। সচেতন শ্রমিকদের ও সচেতন মালিকদের উচিত এই তথ্য উদ্ঘাটনে অধিক জোর দেওয়া।
এই স্বচ্ছতা বিধান হলে অনেকগুলো উপকার হবে। প্রথমত, আবেগের বদলে তখন যুক্তিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। মালিক ও শ্রমিক উভয়েই তখন তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে পরস্পর দরকষাকষি করতে পারবেন। মিডিয়া ও নাগরিকদের কাছে এখন যেমন পোশাকশিল্পের মালিকদের একটা ভয়ংকর খারাপ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা কমে আসবে। শ্রমিকেরা অতিরিক্ত মজুরির দাবিতে ভাঙচুর করে দেশের বারোটা বাজাচ্ছেন—এই অপবাদও কমে আসবে। বিদেশিদের হম্বিতম্বি, অনাহূত হস্তক্ষেপ এবং উপদেশদানের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামও গড়ে তুলতে পারবে ইত্যাদি। এই শুভ পরিস্থিতির সূচনা হতে পারে একমাত্র তখনই, যখন শ্রম মন্ত্রণালয় একটি ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করবে।
৩. দুই ‘দাহ্য পদার্থ’ যখন পাশাপাশি আপাত শান্তিতে বসবাস করে, তখন সহজেই সেখানে যেকোনো সময় আগুন ধরে যেতে পারে। বস্তুত মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কটা ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবে এ রকমই হয়ে থাকে। পুঁজিবাদে এটা হবেই। এতে মালিকেরও দোষ নেই, শ্রমিকেরও দোষ নেই। কিন্তু সভ্য পুঁজিবাদে প্রতিদিন এই দ্বন্দ্ব ভয়াবহ আগুনে পরিণত হয় না। কারণ উভয়ে কতকগুলো নিয়ম মেনে চলেন এবং উভয়ের মাঝখানে প্রতিনিধি স্থানীয় দুটি ‘অগ্নিনির্বাপকযন্ত্র’ থাকে। একটি যন্ত্র হচ্ছে মালিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি সংস্থা, আরেকটি হচ্ছে শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা।
যখন মালিক-শ্রমিকের মধ্যে কোনো বিরোধ ঘটে, তখন আগুন নেভানোর জন্য এই দুটি সংস্থা তৎপর হয়ে ওঠে। ফলে সভ্য পুঁজিবাদে দরকষাকষির মাধ্যমে সমস্যার সাময়িক সমাধান হয়; বড় আগুনের সৃষ্টি হয় না, হলে সেটা মজুরির প্রশ্ন নয়, আরও অনেক বড় মৌলিক ইস্যুতে অনেক দিন পর পর হয়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে এখানে মালিকপক্ষের নির্বাচিত সংগঠন থাকলেও শ্রমিকদের কোনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক প্রতিনিধি নেই। বিশেষত মালিকদের সংগঠনটি ‘জাতীয়’ চরিত্রের অথচ পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত—এ রকম কোনো জাতীয় সংগঠন বা নেতৃত্ব আজও তৈরি হয়নি। এমনকি ‘কারখানা’ স্তরে আইনসম্মত ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকারও আজ পর্যন্ত পোশাকশিল্প খাতের শ্রমিকেরা পাননি। সরকার সেই অধিকারের মৌখিক স্বীকৃতি দিলেও তা বাস্তবায়নের যথাযথ অনুকূল আইন বা তা কার্যকর করার নির্দিষ্ট সময়সীমা আজও তৈরি করে দেয়নি। ফলে এখানে ছোট ইস্যুতে বড় বিরোধ ঘটেই চলেছে। সম্ভবত শ্রেণী হিসেবে মালিকেরা বেশি শক্তিশালী হওয়ায় তাঁদের ভয়ে সরকার সাধারণ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতিগুলোও রক্ষা করতে ভয় পাচ্ছে। অথবা সরকারের মধ্যেই মালিকেরা শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে বিরাজ করছেন বলে সরকার সহজে এসব পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হচ্ছে না। শ্রমিকদের চাপের কারণে মুখে বলছে করবে, কিন্তু কাজ অগ্রসর হচ্ছে না। বরং খারাপ খবর হচ্ছে, সরকার বিশেষ ‘শিল্প পুলিশ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা মালিকদের দাবি ছিল এবং শ্রমিকেরা এর বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। এই ‘শিল্প পুলিশ’ গঠন করার উদ্দেশ্য কী? এর উদ্দেশ্য কি ‘অন্যায়কারীর’ দমন (মালিক-শ্রমিকনির্বিশেষে), নাকি শুধু শ্রমিকদের দমন? যদি শ্রমিকদের দমনই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে নভেম্বর হবে দমন-পীড়নের এবং অশান্তির মাস। কিন্তু এখনই বলে দেওয়া যায় যে সেটা হবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পোশাকশিল্প খাত হচ্ছে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি রপ্তানিমুখী শিল্প। এখানে বিদেশি এনজিও তৎপর, তাদের পেছনে রয়েছে স্বয়ং আমেরিকার সরকার ও বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠী। তাই এখানে দমন-পীড়ন চালাতে গেলে সরকার ও মালিকপক্ষকে দুবার ভাবতে হবে। তা ছাড়া গত সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় পোড়-খাওয়া ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীরাও এখনো মাঠেই আছেন। একবার যদি ক্রমাগত এক সপ্তাহ ধরে জাতীয় পর্যায়ে এই খাতের শ্রমিকেরা ধর্মঘট চালিয়ে যেতে সক্ষম হন, তাহলেই বাইরের অর্ডারে যে ধস নামবে, আন্তর্জাতিক ‘গুডউইলে’ যে সমস্যা সৃষ্টি হবে, তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তখন ডুববেন মালিক-শ্রমিক উভয়েই। সমগ্র পোশাকশিল্পই ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে।
সরকার ও দেশবাসীকে তাই এখন থেকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। নভেম্বর-ডিসেম্বর হোক মালিকদের শান্তির মাস—শ্রমিকদের বিজয় ও অধিকার অর্জনের মাস।
 এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.