বইমেলায় আন্তর্জাতিক কর্নার by ড. সৌমিত্র শেখর

মুখিয়ে আছে বাঙালি! আগ্রহের সুতো এতটা টান টান আর বুঝি বছরের কোনো সময় থাকে না তাদের, যেমনটা থাকে ফেব্রুয়ারির জন্য। সেই ফেব্রুয়ারি এসেই গেছে! ফেব্রুয়ারি মানেই আর দশটা মাস থেকে ভিন্ন কিছু। ফেব্রুয়ারি যতটা ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে, সম্ভবত আর কোনো মাস তা করতে পারেনি।


এর কারণ বোধ হয় এ-ই, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি_মায়ের মাস, শহীদের মাস। বাংলা একাডেমীর বইমেলার সূচনাও হয় পহেলা ফেব্রুয়ারি। সে দিক থেকে ফেব্রুয়ারি বইমেলার মাসও।
বইমেলার আবার মাস হয় নাকি? হয়। বাংলাদেশে হয়েছে। এই তো গত ডিসেম্বরেই 'আন্তর্জাতিক' ছাপ্পা মেরে ঢাকা বইমেলার আয়োজন হলো। প্রতিবছরই হয় আন্তর্জাতিক ঢাকা বইমেলা। এবার হলো বাংলা একাডেমী থেকে কয়েক মিটার দূরে_ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। কিন্তু লোক নেই। খাঁ খাঁ করেছে মেলা প্রাঙ্গণ। এই মেলার আয়োজক সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ক্রেতা না থাকায় এই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলেই বসে ঘুমিয়েছে দোকানি, সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে সেই ছবি। মাঝেমধ্যে ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণেও বইমেলা হয়। ক্রেতা যে খুব বেশি থাকে তা বলা যাবে না। কিন্তু ভিন্ন চিত্র ফেব্রুয়ারির একুশে বইমেলায়। ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে দিন যত যায়, ততই বাড়তে থাকে লোকসমাগম। এই মেলার ক্রেতারা আসেন ঢাকার বাইরে থেকেও। বই কিনতে মফস্বল থেকে ক্রেতারা ঢাকায় আসেন_এটা ভাবলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। এভাবেই একদিন বাংলা একাডেমীর বইমেলা প্রাঙ্গণে জনতার সাগরে জেগে ওঠে ঊর্মি।
আসলে ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে ঘিরেই আমাদের দেশের গ্রন্থপ্রকাশ ও পাঠের জগৎ গড়ে ওঠা। এই মেলায় বই বের হয় প্রচুর, বিক্রিও হয় ব্যাপক। সারা বছর মুখিয়ে থাকা সেই পাঠক মেলায় আসে, প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি করে বই কিনে নেয় পরম তৃপ্তিতে। এ যেন ছেলেবেলায় টিউবওয়েলে মুখ দিয়ে পানি পানের চরম তৃপ্তি! গরমের বিকেলভর দৌড়ঝাঁপ খেলার পর কোনো টিউবওয়েলে মুখ লাগিয়ে পানি পান_আহ্, কোনো কিশোরকে যে কী তৃপ্তি দেয়, যার পরিতৃপ্তির এই স্মৃতি নেই তাকে বোঝানো যাবে না। ফেব্রুয়ারির বইমেলার লোকসমাগম ও বই বিক্রি যে কী পরিমাণের, তার বিবরণও যারা এ মেলা না দেখেছেন তাদের বলে বোঝানো যাবে না। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারার কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহা ছিলেন বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের এই বইমেলার জনক। তাঁর রোপিত বীজই আজ মহীরুহে পরিণত হয়েছে। সেদিনের ছোট্ট সেই বইয়ের পসরা আজ বড় মেলায় রূপ নিয়েছে।
মেলা যেহেতু আয়তনে বেড়েছে, বেড়ে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ থেকে দোয়েল চত্বর, টিএসসি মোড় অবধি এসে পড়েছে; প্রকাশক ও ক্রেতা যেহেতু বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক, সেহেতু মেলা নিয়ে আমাদের ভাবনাটাও বিস্তৃত করতে হবে। ভাবা দরকার, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস_শুধু বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারি নয়। আগে একুশের বইমেলা বলে অনেকে এই মেলায় কোনো ইংরেজি বা অন্য ভাষায় প্রকাশিত বইকেও গ্রহণে আপত্তি করেছেন। কিন্তু পরে বাংলাদেশে প্রকাশিত যেকোনো ভাষার বই-ই এ মেলায় বিক্রির জন্য অনুমোদন করা হয়। তবে আজ পর্যন্ত একুশের বইমেলায় বহির্বিশ্বের কোনো বই অনুমোদিত নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বইমেলার এ কোন সংকীর্ণ চিন্তা!
মনে রাখতে হবে, বইমেলার উদ্দেশ্য কোনো নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে যত বেশি পরিমাণের বই পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরা যায় তার ব্যবস্থা করা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ইন্টারনেট খুব কার্যকর_এ কথা স্বীকার করেও বলা যায়, বইয়ের বিকল্প কিছু নেই, ইন্টারনেটও নয়। বিদেশে নানা বিষয়ে নতুন জ্ঞান সঞ্চার ও তা নিয়ে ভাবনা হচ্ছে। আমাদের দেশের লেখকরাই বা তার সব জানেন কি? বিদেশের ভালো বই না পড়লে, সেই ভালো বই অনুবাদ না করলে দেশে ভালো লেখক জন্মাবে না, ভালো পাঠকও পাওয়া যাবে না। ফলে মননের রাজ্যে ঊষরতা কাটবে না আমাদের। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া কথিত 'আন্তর্জাতিক' বইমেলায় মাত্র দুটো ভিন দেশের স্টল ছিল। ইরান কিছু বই বিক্রি করেছে, ভারতের স্টলে বই বিক্রি হয়নি, 'বিক্রির জন্য নহে' বা 'নট ফর সেল' সিল ছিল বলে। যে মুমূর্ষু 'আন্তর্জাতিক' বইমেলা দেশিদেরই আকৃষ্ট করতে পারেনি, বিদেশিদের তা আকৃষ্ট করবে কী করে? এই আকর্ষণ জাগাতে পারে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের বইমেলা। বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের বইমেলায় অংশ নিতে বাইরে যায়। ব্যক্তিখাতে গড়ে ওঠা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও বহির্বিশ্বে বইমেলায় অংশ নেওয়ার উদাহরণ আছে। বহির্বিশ্বের কোনো কোনো মেলায় বাংলাদেশকে 'থিম কান্ট্রি'ও করা হয়েছে। এতে ওইসব দেশ কিন্তু বাংলাদেশের লেখক ও লেখা সম্পর্কে অবগত হয়েছে এবং এ দেশের সাম্প্রতিক জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেছে। এসব মনে রেখে আমাদেরও কিছু করণীয় আছে নিশ্চয়ই। জ্ঞানের দরজা বন্ধ রেখে যে মুক্তি নেই, এ কথা পাগল আর শিশু ছাড়া সবাই বোঝে। আর বোঝে বলেই ভরসা করা যায়। একুশে যেহেতু আজ আন্তর্জাতিক আবেদনময়, বহির্বিশ্বের বইমেলায় যেহেতু সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমাদের অংশগ্রহণ আছে, বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ বই যেহেতু আমাদের লেখক-পাঠকদের মননশীলতার দুয়ার উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে_সেহেতু বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বইমেলায় কেন একটি 'আন্তর্জাতিক কর্নার' থাকতে পারে না? আমি জানি, এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেশপ্রেমের স্লোগান দিয়ে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা প্রথমেই করবেন আমাদের প্রকাশক বন্ধুরা। যারা বিদেশি বই পাইরেসি করেই মূল ব্যবসা করছে, তারা তো আরো বেশি দেশপ্রেমিক হয়ে যাবে ওই মুহূর্তে। পাঠক জানেন, তারা পাইরেসি করে জনপ্রিয় বইয়ের, নতুন ও সদ্য প্রকাশিত প্রয়োজনীয় বই নয়। সদ্য প্রকাশিত প্রয়োজনীয় বইয়ের প্রতি লেখক-পাঠকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে একমাত্র মেলায়ই। আর সে কারণেই বাংলা একাডেমীর বইমেলায় ছোট করে হলেও একটি 'আন্তর্জাতিক কর্নার' খুবই প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দেশীয় প্রকাশকদের 'আবদার' রক্ষা করে বিদেশি বাংলা বই বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে। তবে লোক দেখানো 'আন্তর্জাতিক কর্নার' করলেই আবার চলবে না, সেখানে যেন গুরুত্বপূর্ণ দেশ থেকে প্রকাশকরা তাঁদের বই বিক্রি করতে আসেন, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। শুধু সরকারি 'নিউজ লেটার' গোছের পত্রিকা বিক্রি বা বিতরণ করলে 'আন্তর্জাতিক কর্নার' না থাকাই ভালো।
বাংলা একাডেমীর বইমেলায় 'আন্তর্জাতিক কর্নার' হলে এ দেশের লেখক ও পাঠককুল উভয়ই উপকৃত হবেন। আরো ভালো এবং সংখ্যায় বেশি লেখক সৃষ্টি হওয়ার বাতাবরণ তৈরি হবে, অনুবাদ করার আগ্রহ বাড়বে এবং সেই অনুবাদ পাঠ করে সাধারণ পাঠক ঋদ্ধ হবেন। সব মিলিয়ে দেশি প্রকাশকরাও আখেরে লাভ করবেন বেশি।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
scpcdu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.