গোধূলির ছায়াপথে-‘ইউ ওল্ড ফুল’ by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

আমার এমন কিছু বয়স হয়নি। দেখতে বেশি মনে হলেও একজন তরুণ ব্যক্তি আমি। যাঁরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের কথা আজকাল বেশি মনে হয়। দিন গত হয়ে যাচ্ছে বলে আগের দিনের মানুষের কথা ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। পুরান ঢাকার পাতলা খান গলিতে এক ভদ্রলোক রোজই আসতেন পিতার দর্শনার্থী হয়ে।


পিতা সব সময় প্রস্তুত নন, সময় দিতে হতো আমাকেই। এ রকম ইন্টারেস্টিং মানুষ কম দেখেছি। ইউরোপের শহরে শহরে সময় কাটিয়েছেন, চার-পাঁচটি বিদেশি ভাষায় অনায়াস অবস্থান; ঢাকা, নোয়াখালী, চিটাগাং, সিলেট, কুমিল্লা, রংপুরের কথ্য ভাষায় অনায়াস বাকশ্রুতি। কানাডিয়ান ও অস্ট্রেলিয়ানরা যেভাবে ইংরেজি খবর পড়েন, তাও তাঁর কণ্ঠদর্পণে। গান জানতেন, ক্ল্যাসিক্যাল। গলাটিও মন্দ নয়। পুরানা পল্টনে বাস করতে এসেছি একান্ন সালে। তাঁর আর দেখা পাইনি। এতগুলো বছর ছিলাম তাঁর অন্বেষণে। কোথায় হারিয়ে গেলেন ভদ্রলোক? পঞ্চাশ বছর আগের পরিচিত আনোয়ারুল হক নামের নাট্য-সংগীত-সংস্কৃতি মুখরিত ব্যক্তিটির মৃত্যুসংবাদ পাঠ করলাম বছরখানেক আগে। বয়স হয়েছিল এক শর কাছাকাছি। তাঁর আত্মার উদ্দেশে দরুদ পাঠ করলাম।
শতবর্ষীরা জাপানে প্রায় প্রতিদিনই টেলিভিশনে উপস্থাপিত। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আহরিত এসব লোলচর্ম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আগাম চেহারার ছবি খুঁজে পাই তাঁদের মধ্যে। সুযোগ পেলেই রোটারি-জগতের বয়স্কদের কাছে বসি। কথা বলি, অনুমতি নিয়ে ঘাড় মেসাজ করে দি। অবাক হয়ে বয়স্ক বন্ধুরা তাকিয়ে থাকে। কিঞ্চিৎ আরামটুকু গ্রহণ করার সময় তাঁদের অভিব্যক্তি দেখার মতো। অভাবিত আচরণ বাধ্য-বালকের মতো মেনে নেন তাঁরা, বিনম্র অনুভূতিতে নত ভালোবাসায় যার উৎপত্তি। মাস চারেক থেকে এই কাগজে অধমের কলাম বেরোনোর পর ইন্টারনেট ও ফেসবুকে যে ফিডব্যাক পাই, তাতে কেউ লিখেছেন: ‘আপনি বিগ জিরো নন’, ‘আপনি অপরাধী নন’। উল্টোটাও। একজন লিখছেন: ‘সত্তর-পরবর্তী জীবনে বৈপরীত্য থাকতে নেই’। ‘জীবন নদীর উজানে’র প্রথম বাক্য: ‘আমি কিছুই নই’। লিখেছিলাম: ‘সংগীতের সমর্পণ ও প্রভু সমর্পণের মধ্যে বৈপরীত্য খুঁজে পাইনি’।
বাসে উঠতে পথ চলতে বয়স্কদের কতটুকু সম্মান দেখাই আমরা? কদিন আগে ঈদের বাজারে বায়তুল মোকাররমে গাড়ির সামনে পড়ে যাই। সজোরে ব্রেক কষে গাড়ির শার্সি উঠিয়ে শুনি তরুণের সম্ভাষণ—‘ইউ ওল্ড ফুল’। অনুযোগ পিতা-মাতার কাছে, এই সন্তান আপনার? নেমে এসে যদি জিজ্ঞেস করত, কোথাও ব্যথা লাগেনি তো? তাহলেই তো তাকে আলিঙ্গন করতাম।
বিশ্ব প্রবীণ দিবসের নানা আহ্বানে আজিজুল হক সাহেব আমাকে ডাকতেন। বলতেন, যেদিন বুড়ো হবে, সেদিন বুঝবে বুড়ো হওয়ার কী জ্বালা। উত্তর দিতাম, বুড়ো হব না, চিরতরুণ থাকব। গাইতাম গানটি: ‘আমাদের পাকবে না চুল গো, আমাদের পাকবে না চুল’। রোটারির মাধ্যমে প্রবীণদের নানা কার্যক্রমে আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম। এসবের মধ্যে একটি, বৃদ্ধ বয়সে প্রস্টেটের সমস্যা। গান শোনালে কী হবে, রবিঠাকুর এই সমস্যাতেই জীর্ণ হয়ে ঝরে পড়েন।
চ্যানেল আইয়ের জন্মদিনে চিরনবীনরা আমার পাশে—এবিএম মূসা, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আতাউর রহমান, কামাল লোহানী, ডক্টর এনামুল হক, মুস্তাফা মনোয়ার, অর্থাৎ আমার মন্টু ভাই। হঠাৎ কী মনে হলো, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। মন্টু ভাই অবাক হয়ে তাকালে বললাম: আল্লাহ্ বলেছেন, আমাকে দেখতে পাবে না। যদি তোমার চেয়ে এক দিনের বেশি বয়স্ক মানুষকেও সম্মান জানাতে পারো, জানবে আমাকেই সম্মান করলে। তিনি আমার জ্যেষ্ঠ, একসঙ্গে কলকাতায় ও ঢাকায় মানুষ হয়েছি। সালাম করিনি কোনো দিন।
রাতে পাঁচ বছরের নাতি আলভি ঘুমুতে যাওয়ার আগে গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকে। রোজ নতুন গল্প সাপ্লাই করতে হয়। গল্প দিলাম উল্টো:
এক যে ছিল রাজা, তার ছিল তিন রানি। কোনো রানিকেই রাজার পছন্দ নয়। রাজার শখ তাঁর থাকবে রাবণের গুষ্টি, রাজত্বকে বাড়িয়ে দেবে পৃথিবীর শেষ সীমানা পর্যন্ত। অবশেষে তিন রানির হলো তিন ছেলে। প্রথমটি অবাধ্য। কারও কথা শোনে না। পরেরটি সাধারণ। অল্প অল্প কথা শোনে। আর শেষেরটি ভীষণ বাধ্য। বাবা-মায়ের কথা শোনে। যে বাবা-মায়ের কথা শোনে, সে আসলে সবচেয়ে ভালো। সে কাউকে ‘ইউ ওল্ড ফুল’ বলে না। তার চেয়ে এক দিনের বড়কেও সম্মানের চোখে তাকায়। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমাকে দেখতে পাবে না। বয়স্ক কাউকে সম্মান করলে যেন আমাকেই সম্মান করলে। রাজার এই তৃতীয় সন্তানটি, যে সবাইকে সম্মান করত, সে-ই দেশে বয়ে আনল সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি।
আলভির চোখে ঘুম এসে গেছে। অনেক কষ্টে চোখ দুটো বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওই ছেলেটির নাম কী?
চুমু খেয়ে বললাম: আলভি।
ও কাউকে ‘ইউ ওল্ড ফুল’ বলে না।
 মুস্তাফা জামান আব্বাসী: লেখক-গবেষক, সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.