মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-জামায়াত নেতা মীর কাসেম গ্রেপ্তারের পর কারাগারে

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, অগি্নসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে গতকাল রবিবার বিকেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।


বিকেল সোয়া ৪টার দিকে তাঁকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে তাঁকে রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়। সেখান থেকে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কারাবন্দি রাখতে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আজ এ আবেদনের ওপর শুনানি হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সাত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। একই অপরাধে বিএনপির দুই নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় নিজ অফিসকক্ষ থেকে মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর ঘণ্টা দেড়েক আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, রবিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মতিঝিলে দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরপরই তাঁকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক মীর কাসেমকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। আদেশ হাতে পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন তিনি। এক পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মীর কাসেম আলী আগে থেকেই নজরদারির মধ্যে ছিলেন। এ কারণে আদেশে বেঁধে দেওয়া সময়ের চেয়ে কম সময়ের মধ্যেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের আদেশ পালন করা সম্ভব হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, পরোয়ানা জারি হওয়ার পরপরই প্রথমে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা শুরু করে। শীর্ষস্থানীয় এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে জানিয়ে তাঁকে কিভাবে গ্রেপ্তার করা যায় তার একটি ছক তৈরি করেন। পালানোর সম্ভাবনা মাথায় রেখে দ্রুত গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মীর কাসেমের অবস্থান নিশ্চিত করে। এরপর মতিঝিল থানা পুলিশকে নয়াদিগন্ত অফিসের দিকে নজরদারি করতে বলে কাসেমকে গ্রেপ্তার করতে রওনা দেয় ডিবির কয়েকটি দল। পুলিশ দ্রুত নয়াদিগন্ত অফিসের চারদিক ঘিরে ফেলে। ওই সময় দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মীর কাসেম। এ অবস্থায় গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল দৈনিক নয়াদিগন্ত কার্যালয় থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। সেখান থেকে মীর কাসেমকে প্রথমে ডিবি অফিসে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তা না করে পরে তাঁকে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়।
গতকাল বিকেলে ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেম আলীকে হাজির করার খবর পেয়ে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামসহ তাঁর আইনজীবীরা হাজির হন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত, মোখলেসুর রহমান বাদল, নুরজাহান মুক্তাসহ বেশ কয়েকজন হাজির হন। সন্ধ্যায় ট্রাইব্যুনাল মীর কাসেম আলীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেন। তাঁকে আজ সকালে পুনরায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে বলা হয়।
পরে প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা জানতে পেরেছি, ট্রাইব্যুনাল তাঁকে হাজতি পরোয়ানা দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে কাল (সোমবার) হাজির করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।'
অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, 'আমরা তাঁর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে ওকালতনামা দাখিল করার অনুমতি চাইতে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে দেখা করি। ট্রাইব্যুনাল আগামীকাল (সোমবার) কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার পর আইনগত সব কিছু করার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন।'
সাক্ষীদের ভয় দেখানোর অভিযোগ : মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের পাশাপাশি তাঁকে গ্রেপ্তার করতে আবেদন উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেন, কাসেমের বিরুদ্ধে যাঁরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন তাঁদের হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। সাক্ষীদের তদন্ত সংস্থার কাছে সাক্ষ্য দিতে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আবেদনে আরো বলা হয়, তিনি (কাসেম আলী) প্রভাবশালী ব্যক্তি। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ সফর করে এই ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ট্রাইব্যুনালের ভাব-মূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। তাঁকে কারাবন্দি রাখা না হলে তদন্তে বাধা সৃষ্টি করবেন এবং আলামত নষ্ট করবেন। এ ছাড়া বাইরে থাকলে পালিয়ে যাবেন। ফলে তদন্তকাজ বিঘি্নত হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলী একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতাকারী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশেই চট্টগ্রামে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্পে বহু লোককে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে, তাঁদের তালিকা তৈরিতে মীর কাসেমও ছিলেন। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের মীর কাসেমকে একাত্তরে চট্টগ্রামের মানুষ চিনত মিন্টু নামে। বাবার চাকরি সূত্রে চট্টগ্রামে যান তিনি। সেখানে কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
জামায়াতের নিন্দা : মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সরকার জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক 'মিথ্যা মামলা' দিয়ে তাঁদের কারাগারে আটক রেখে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়।
ডা. শফিক বলেন, 'আমরা বারবার বলে আসছি, যে আইনে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সরকার বিচারের নামে প্রহসন করছে, তা একটি কালো আইন।' তিনি আরো বলেন, জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করার অংশ হিসেবে সরকার মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে 'মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট মামলা' দায়ের করে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।

No comments

Powered by Blogger.