চারদিক-শতায়ু হোন আজিজা ইদরিস by সুমনা শারমীন

শুয়ে থাকার মানুষ তিনি নন। সংসার থেকে সমাজকর্ম—সব জায়গায় সব সময় তিনি ছিলেন তৎপর। এমনকি ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮৩ বছর বয়সে নিজের অসুস্থতাকে দৃঢ় মনোবল দিয়ে অতিক্রম করে হুইল চেয়ারে করে ভোট দিতে গিয়েছিলেন।


একটি ইংরেজি দৈনিকে তখন ছাপা হয়েছিল তাঁর মনের অনুভূতি, ‘কিছুদিন আগে আমার অপারেশন হয়েছে এবং আমাকে ঘোরাঘুরি করতে মানা করা হয়েছে। কিন্তু আজ যখন আমার ছেলে ও ছেলের বউ ভোট দিতে যাচ্ছিল, তখন আমি ভোট দিতে পারব না বলে কান্না পাচ্ছিল। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে চিকিৎসক পুত্রবধূ সামিনা আর বড় ছেলে কাজী শীশ ব্যবস্থা নিয়ে আমাকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। আমার বয়স ৮৩। কে জানে, পরের নির্বাচন আমি নাও দেখতে পারি। তারা আমার জীবনের সম্ভবত, শেষবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আজ আমি খুবই খুশি।’ কথাগুলো বলেছিলেন আজিজা ইদরিস। মির্জা আজিজা ইদরিস। সেই মানুষটি এখন শুয়ে আছেন ঢাকার বারডেম হাসপাতালের একটি বিছানায়। ভুগছেন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে। অবস্থার অবনতি হলে একবার তাঁকে রাখা হচ্ছে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে, আবার ফিরে আসছেন কেবিনে, আবার যাচ্ছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে....। যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁরা জানেন কর্মী, প্রগতিশীল আধুনিক মনের এই মানুষটাকে আর যা-ই হোক বিছানায় শুয়ে থাকা মানায় না।
১৯২৬ সালের ২১ মার্চ জন্মেছিলেন তিনি দিনাজপুর জেলার মির্জাপুর গ্রামের মির্জা পরিবারে।
১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের সঙ্গে। স্বামীর রাজনৈতিক-সাহিত্যিক বন্ধু, আত্মগোপনকারী বিপ্লবী কর্মী, বন্ধু থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার জন্যই তাঁর আতিথেয়তা, আপ্যায়ন ছিল একই রকম আন্তরিক। বিয়ের পর কলকাতায় ১০ বছরের জীবনে স্বামীর বন্ধুদের চিন্তাভাবনা, কাজকর্মের সঙ্গে তিনিও কিছুটা পরিচিত হন। দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মহাযুদ্ধজনিত দুর্ভিক্ষ দেশ বিভাগ...।
একসময় স্বামীর আদর্শ অনুসরণ করে রাজনীতিতে যোগ দেন। আর সেই যে শুরু সমাজকর্মের সঙ্গে, তা তো চলছেই। তাই তো বলেছি, নাকে নল, যন্ত্র বেঁধে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা তাঁকে যে মানায় না।
বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে তাঁর পরিচয় কলকাতায়। পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসে আজিজা ইদরিস তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন মহিলা সংগঠনে। আতিকা বতুল খানমের অনুলিখনে আমার জীবন কথা বইয়ে নিজেকে তিনি বলেছেন মহিলা সংগ্রাম কমিটি, মহিলা পরিষদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টির অক্লান্ত কর্মী।
ঢাকার গোপীবাগের একটি বাড়ি। বাড়ির কর্তা কাজী মোহাম্মদ ইদরিস আর কর্ত্রী আজিজা ইদরিস। এই বাড়ির বৈঠকখানা মানেই প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা মানুষের মিলনস্থল। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্মও হয়েছে এই বৈঠকখানায়। বাড়ির কর্ত্রী মধ্যবিত্ত সংসারের সব দায়িত্ব পালন করে নিজে জড়িয়েছেন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। মানুষ করেছেন তিন মেয়ে ও তিন ছেলেকে। বারডেম হাসপাতালে আজিজা ইদরিসকে যেদিন দেখতে গেলাম, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের বাইরের চেয়ারে বসে ছিলেন বড় মেয়ে কাজী মদিনা (নামটা কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া)। তিনি বললেন, ‘আম্মার যে গুণটা সবচেয়ে বেশি আমাদের আকর্ষণ করে, তা হলো আত্মমর্যাদাবোধ। আম্মার তো কোনো ডিগ্রি নেই, কিন্তু তাঁর মতো আধুনিক চিন্তার মানুষ আমরাও কি হতে পেরেছি?’
অকালে স্বামীহারা হলেন ছোট মেয়ে কাজী সেলিনা। আজিজা ইদরিস বলেছিলেন, ‘কত মেয়ের দুঃখে পাশে দাঁড়ালাম, আমার নিজের মেয়েটার মনে এত কষ্ট! কিছুই তো করতে পারলাম না।’
কারও অসুখ, কারও বিপদ, কারও গর্ব করার মতো কোনো আনন্দ সংবাদ; হোক না শরীর বিপক্ষে, থাক না পথের ঝামেলা—আজিজা ইদরিস ঠিক পৌঁছে যেতেন জায়গামতো। ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’...এই চেতনা নিয়েই ঘরে-বাইরে কাজ করে গেছেন সমাজসচেতন অসাম্প্রদায়িক মানুষটি। ফতোয়ার বিরুদ্ধে সমাবেশ—আজিজা ইদরিস আছেন সেখানে। বাংলাদেশের নারীর অধিকার অর্জনে আইন সংস্কারের জন্য সভা, মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রতিবাদ মিছিল, কিংবা ঊনসত্তরে কালো পতাকা হাতে নারীসমাজের সেই মিছিল—ব্যানারে লেখা, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ/ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। সেখানেও আজিজা ইদরিস। সত্যিই তো আমাদের আগের প্রজন্ম ভয় পায়নি বলেই আজকে তাদের তৈরি করা পথে হাঁটছি আমরা। অতীতকে বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ নয়। আজকের যে কিশোরী নিজের বাল্যবিবাহ নিজেই বন্ধ করছে, আজকের যে তরুণী নিজের পছন্দের বিষয়ে লেখাপড়া করতে একাই বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, যে মেয়েটি সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করছে, তারা সবাই কৃতজ্ঞ আজিজা ইদরিসদের কাছে, সেই প্রজন্মের কাছে।
আজিজা ইদরিস আপনি আবার সুস্থ হয়ে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলুন। শতায়ু হোন।

No comments

Powered by Blogger.