অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত-ব্যাংক খাতে দুর্নীতি

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার সংস্কৃতি নতুন নয়। এই অসৎ কাজে ক্ষমতাসীন মহলের একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি যে তদবির ও চাপ সৃষ্টি করে ঋণখেলাপিদের সহযোগিতা দেন, সেটাও নতুন নয়। যেটা নতুন তা হলো, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বড় কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ভাষণে এসব অনৈতিক কাজের প্রকাশ্য সমালোচনা।


গত শনিবার এক সেমিনারে এসব ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে দেশের প্রভাবশালী ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা যে কঠোর ভাষায় এসব অপকীর্তির চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে আশাবাদী হওয়া যায়। এরপর দেশের অর্থনীতির কান্ডারিদের চুপ করে বসে থাকার উপায় নেই।
বাংলাদেশে সেনাশাসনের সময়, সেনা কর্মকর্তা এবং তৎকালে মন্ত্রীদের নির্দেশে ও তাঁদের সরাসরি হস্তক্ষেপে ঋণ বিতরণ-প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। তাঁরা শিল্পের কথা বলে ঋণ নিয়ে গাড়ি-বাড়ি ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। একসময় তাঁদের ঋণ সুদে-মূলে মওকুফ করে দেওয়া হয়। সরকারই যখন এই অনৈতিক কাজ করে, তখন ব্যাংক কর্মকর্তারা কেন করবেন না? এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণের সংস্কৃতি চালু হয়। এই ঋণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দাবি করেন, তাঁরা তো ঋণ গ্রহণ করেননি, (সোজা ভাষায়, ঘুষের মাধ্যমে) ঋণ ক্রয় করেছেন। সুতরাং ঋণ পরিশোধের কোনো দায়দায়িত্ব তাঁদের নেই। আর এই অনৈতিক কাজে সহায়তা করেন ব্যাংকের ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাবশালী নেতারা। এই অপসংস্কৃতির অবসান এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
ব্যাংক খাত অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এখানে সামান্য আস্থার অভাব সৃষ্টি হলে যে কী বিপর্যয় ঘটে, তা সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকেই বোঝা যায়। আমেরিকায় ‘সাব প্রাইম লেন্ডিং’ (সক্ষম নয় কিন্তু তাদের ঋণ দেওয়া) শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যায়। এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে ঋণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখাতে হবে। সরকার বা প্রভাবশালীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিয়মবহির্ভূত ঋণ দিয়ে লোকসানের বোঝা বাড়ানো যাবে না। ব্যাংকের টাকা মানে জনগণের টাকা। এর অপচয় চলতে পারে না। ব্যাংককেও ব্যবসা করতে হবে। লাভ করতে হবে।
খেলাপি ঋণ উদ্ধারেও নতুন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বর্তমানে পাঁচ বছর খেলাপি থাকলে সেই ঋণ হিসাবের খাতা থেকে অবলোপন বা পৃথক করে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট পরিষ্কার রাখা হয়। আর মামলা করে অনাদায়ি ঋণ আদায়ের দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হয়। মামলায় জিতলেও ব্যাংকের তেমন লাভ হয় না। কারণ, আদালতের মাধ্যমে নিযুক্ত রিসিভার কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলেই ঋণখেলাপিরা আবার আদালতের শরণাপন্ন হন। এভাবে মামলার চক্র চলতে থাকে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, ব্যাংকগুলোকে পেশাদারির ভিত্তিতে চলতে দিতে হবে। ব্যাংকে পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়োগ, ঋণ বিতরণ-আদায়সহ সব ধরনের কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিচালকের মাধ্যমে চালাতে দিতে হবে। আর যেহেতু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো এখন কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়েছে, ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, বরং ব্যবসায়িক লাভালাভ বিবেচনা করেই ব্যাংকগুলোকে চলতে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বা সরকারের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আর ঋণ প্রদানের জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অসাধু ব্যবসায়ীদের চাপ, একশ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তার কারসাজি ও অসাধু সিবিএ নেতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। না হলে ঋণ খেলাপের ধারা বন্ধ হবে না।

No comments

Powered by Blogger.