কমনওয়েলথ গেমস-উদীয়মান ভারতের তলার অন্ধকার by পঙ্কজ মিশ্র

গত ১ অক্টোবর বিকেলে উত্তর ভারতের সাধারণ স্থানগুলো ছিল পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য দিয়ে বোঝাই। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয় ‘গোলযোগ সৃষ্টির’ অভিযোগে। মোবাইল ফোন থেকে গণখুদেবার্তা প্রেরণ নিষিদ্ধ করা হয়।


দুই দিন পর কমনওয়েলথ গেমসের উদ্বোধনের সঙ্গে এসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থার কোনো সম্পর্ক ছিল না। বহু ভারতীয় আশা করেছিল, এই আসরের মধ্য দিয়ে বিশ্বশক্তি হিসেবে ভারতের প্রতীকী আবির্ভাব ঘটবে।
আসলে সেদিন পুলিশ মোতায়েনের পেছনে কারণ অযোধ্যা শহরের একটি বিতর্কিত স্থান নিয়ে আদালতের রায় ঘোষণা। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা স্থানটিকে রামের জন্মভূমি হিসেবে দাবি করে আসছে। এ ভূমিতে নির্মিত ষোড়শ শতাব্দীর একটি মসজিদ হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ১৯৯২ সালে ভেঙে দিলে যে ভয়ানক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, সরকার তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায়নি।
আদালতের রায়ে হিন্দুরা পেল দুই ভাগ, আর মুসলমানেরা পেল এক ভাগ। রায় ঘোষণার কিছুক্ষণ পর আমি হিমালয়ের পাদদেশে আমার বাড়ির কাছের একটি গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম। এ গ্রামটি অযোধ্যা থেকে ৬০০ মাইল দূরে। এখানেও গ্রামবাসীরা বেশ সতর্ক। মার্কেট অংশত বন্ধ। দোকানের ঝাঁপ ফেলে টেলিভিশনে ছিল দোকানিদের চোখ।
এই পাহাড়ি গ্রামে বাইরে থেকে আসা শ্রমিকেরাই শুধু তখনো কাজ করছিলেন। এঁরা মধ্য ভারত থেকে শত শত মাইল পেরিয়ে এখানে এসেছেন। পাহাড়ের পাদদেশের নির্মাণ-প্রকল্পগুলোয় ভারী পাথর মাথায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল নারী, পুরুষ, এমনকি শিশুশ্রমিকেরাও। বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের সহজেই চেনা যায়। মা-বাবা ছোটখাটো হালকা-পাতলা গড়নের; রোগা ও শ্যামলা। তাঁদের শিশুদের পেট ফোলা, ময়লা পড়া বাদামি চুল। অপুষ্টির লক্ষণ স্পষ্ট। সারা দিন ধরে তাঁরা দিল্লির বিত্তশালীদের জন্য গ্রীষ্মকালীন আবাস নির্মাণ করেন, আর রাতে টিনের চালার নিচে গাদাগাদি করে বসবাস করেন।
শ্রমিকেরা আদালতের রায়ের কথা শোনেননি। আবহাওয়া যতই ঠান্ডা হতে থাকে, নিজেদের সুরক্ষার ভাবনা ততোই প্রধান হয়ে ওঠে। এই গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে তাঁদের ঘরের চাল উড়ে গেছে। এসব শ্রমিক পশ্চিমা দেশে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া বিষয়ে নিস্পৃহ থাকবে, সেটাই সংগত মনে হয়।
তাহলে ধনী দেশগুলোর কাছে ভারতের ভাবমূর্তি নিয়ে কারা উদ্বিগ্ন? বিত্তশালী অল্পসংখ্যক অভিজাতেরা? গত কয়েক মাসে তাদের দুর্ভাবনার লম্বা তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ছিল অযোধ্যা নিয়ে সহিংসতার আশঙ্কা। এমন ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, ‘আমরা নতুন ভারত রচনার যত চেষ্টাই করি না কেন...পুরোনো ভারত এখনো আমাদের লজ্জায় ফেলার ক্ষমতা রাখে।’
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর উপত্যকায় গত জুন মাস থেকে গণবিদ্রোহ চলছে। ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদার সঙ্গে এর মিল অনেক। সেখানে কঠোর কারফিউ উপেক্ষা করে, বিপুলসংখ্যক কাশ্মীরি মুসলমান ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিক্ষোভে তরুণেরাই বেশি। বিক্ষোভকারীদের পাথর নিক্ষেপের জবাবে সেনারা গুলিবর্ষণ করেছে। গুলিতে নিহত হয়েছে শতাধিক কাশ্মীরি, যাদের বেশির ভাগই কিশোর। গুলিবর্ষণের ফলে আসবে জঙ্গিবাদীদের পাল্টা আঘাত, আর ফায়দা লুটবে পাকিস্তানের কট্টর ইসলামপন্থীরা।
মধ্য ভারতে পূর্ণমাত্রার বিদ্রোহ চলছে। মাও সে তুংয়ের রণকৌশলে উদ্বুদ্ধ গেরিলা যোদ্ধারা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রস্তুত। তারা মনে করে, উপজাতীয় জনগণকে খনিজ-সমৃদ্ধ ভূমি থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রে বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর সঙ্গে সরকারও সক্রিয়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রতীক রেলপথ, অস্ত্রাগার ও পুলিশ স্টেশনে মাওবাদীরা আক্রমণ করে চলেছে।
ভারতের অপ্রতিরোধ্য উত্থানের যে বিভ্রম বিত্তবান ভারতীয়দের মনে তৈরি হয়েছে, তাতে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছে কমনওয়েলথ গেমস। দিল্লিকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে বেদনাদায়ক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। অনেকে মনে করেছেন, এই প্রতিযোগিতা ভারতের ধর্মীয় ও শ্রেণীগত সংঘাতের পুরোনো ভূত নামাবে, আর আন্তর্জাতিক পরাশক্তির উচ্চাসনে বসার দাবি জোরালো করবে।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের বহু আগেই এ প্রতিযোগিতার ওপর কলঙ্কের ছাপ পড়ে। দুই সপ্তাহ আগে প্রধান স্টেডিয়ামটির সঙ্গে যুক্ত একটি বড় ফুটওভারব্রিজ ভেঙে পড়ে। গেমসের পরিচালনাকারী ফেডারেশন বলেছে, অ্যাথলেটদের থাকার জায়গা ‘বসবাসের অযোগ্য’। বন্য প্রাণীর উপদ্রব থেকে ভেন্যুগুলোকে রক্ষার জন্য লেঙুর বানরের এক বাহিনী নিয়োগ করতে হয়েছে। সরকারের ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’ পর্যটন প্রচারণাতে উঠে আসা সুন্দর নিসর্গভূমির চেয়ে অনেক বেশি ছড়িয়েছে ভঙ্গুর মাঠ আর নোংরা টয়লেটের ছবি।
রেটিং এজেন্সি মোডি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এই ব্যর্থতা ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ক্ষুব্ধ স্থানীয় পর্যবেক্ষকেরা তুলোধোনা করেছেন ‘জাতীয় লজ্জার’ জন্য দায়ী রাজনীতিক ও কর্মকর্তাদের।
ভারতের নিজস্ব ভাবমূর্তির জন্য এ আঘাত খুব পীড়াদায়ক। আবার নতুন ভারত নিয়ে যে ভ্রান্তি ছড়িয়েছে, তা খুবই অবিবেচনাপ্রসূত। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তেজি ভাব, সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ভারতীয় বড় ব্যবসায়ীদের নজরকাড়া উপস্থিতি, আর দেশের বাইরে সফল ভারতীয়দের ঔজ্জ্বল্য ছড়ানো—এসব মিলে ভারতের কিংবা বলা যায় ইংরেজি-ভাষী ভারতীয়ের যে চেহারা নিয়েছে, তা পশ্চিমা মডেলের আধুনিকতার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খায়।
ভারতে বহু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আছে, যা অধিকাংশ অপশ্চিমা সমাজে দেখা যায় না। এটা ভারতের নিজস্ব ভাবমূর্তি নির্মাণে সহায়ক হয়েছে। এসবের কারণে আন্তর্জাতিক স্তরে কর্তৃত্বপরায়ণ চীনের চেয়ে ভারতকে বেশি ‘স্থিতিশীল’ গণ্য হয়। তবে বেইজিংকে মধ্য ভারত ও কাশ্মীরের বিদ্রোহের মতো গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যা কিংবা অতিরিক্ত চাপের কারণে হাজার হাজার কৃষকের আত্মহত্যার মতো বড় ট্র্যাজেডি মোকাবিলা করতে হয় না।
ভারত একটি উদ্যমী গণতন্ত্র আর সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ, এ বয়ানটিতে যতটুকু বাস্তবতা ফুটে ওঠে, তার চেয়ে বেশি আড়াল হয়। ফোর্বর্স ম্যাগাজিনের বিলিয়নিয়ার তালিকায় ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি একদমই গ্রাহ্যে আনা হচ্ছে না সমাজের গভীরে প্রোথিত অসমতা; ধনী-গরিবের মধ্যে আয় ও সম্পদের ক্রমবর্ধমান ফারাক।
একটি চালু কথা হলো, ভারতে একই সময় কয়েক শতাব্দীর দেখা মেলে। শুধু তা-ই নয়, ভারত বহু বয়ানেরও দেশ। বয়ানগুলো অবিরত, কখনো কখনো বেদনাদায়কভাবে পরস্পরকে ছাপিয়েযায়। কমনওয়েলথ গেমস ভারতের প্রগতির প্রদর্শনী। এটি আয়োজন করতে গিয়ে দিল্লির সবচেয়ে বঞ্চিত এক লাখ মানুষকে হতে হয়েছে ছিন্নমূল। চীন যেভাবে অত্যাধুনিক নগরে বেমানান গরিব মানুষদের বিতাড়ন করে, দিল্লি থেকে এসব মানুষকে উচ্ছেদ তার চেয়ে কোনো অংশে কম নির্মম নয়।
আমার গ্রামে যে শ্রমিকেরা শহরের সুবিধাভোগী মানুষদের ছুটি কাটানোর নির্জনবাস নির্মাণ করছেন, তাঁরা ভারতের নানা প্রান্তের উদ্বাস্তু মানুষ।
সচ্ছল ভারতীয়দের আশঙ্কা, অযোধ্যা রায়ের মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু একের পর এক মুসলমানবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে ১৯৯৮ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতাসীন হয়ে এমন সব নীতি অনুসরণ করে, যা দেশের অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এবং রাজনীতিতে করপোরেটের বিশেষ স্বার্থকে প্রোথিত করে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ভূগর্ভে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়, আর পাকিস্তানকে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দেয়। ফলে জন্ম নেয় চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ। এর উত্তরাধিকার এখন বহন করে চলেছে ভারত। দিল্লির পরবর্তী সরকারগুলো এবং কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনী এই মন্ত্রের দ্বারাই চালিত হচ্ছে।
বর্তমান মধ্যপন্থী কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের অর্থপূর্ণ কোনো তফাত খুঁজে না পাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই কাশ্মীরের ৪০ লাখ মুসলমানকে দায়ী করা যায় না। কাশ্মীরবাসী প্রতিদিন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দখলদারির নৃশংসতার শিকার। একটি বিকারগ্রস্ত জাতিরাষ্ট্রের অন্তহীন অবরোধের ভেতর আটকে থাকা সংখ্যালঘুর ভাগ্যই তারা বরণ করে রয়েছে।
রাষ্ট্রের কোথাও লাখ লাখ ভারতীয়ের স্বর শোনা যায় না। তাদের মতোই আমার গ্রামের সেই নির্মাণশ্রমিকেরা পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজের নিপীড়ন আর নতুন ব্যবসামনস্ক ভারতের নির্দয় শোষণের মধ্যে কোনো তফাত বুঝতে পারে না। তাদের নাজুক বাসস্থান ধ্বংস হওয়ার মধ্যে কী প্রতীক আছে। ভারতের ভাবমূর্তির জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হয়তো এখানেই যে, এসব মানুষ হয়তো একদিন চালাঘরে একসঙ্গে গুটিসুটি মেরে আর থাকবে না; মধ্য ভারতের মানুষদের মতোই সশস্ত্র বিদ্রোহে নামবে।
এই গ্রীষ্মে ভারতের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো শিগগিরই স্মৃতি থেকে বিলীন হবে। কিন্তু ভারতের আধুনিকতার উচ্ছ্বসিত বয়ানকারীদের প্রতি তাদের নসিহত অত্যন্ত স্পষ্ট। জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন একদা লিখেছিলেন, ‘সভ্যতার এমন কোনো দলিল নেই, যা একই সঙ্গে বর্বরতারও দলিল নয়।’ ‘উদীয়মান’ ভারত-সম্পর্কিত সব বয়ানে এই বিষণ্ন সত্যের স্বীকৃতি থাকতে হবে। নয়তো ভাঙা সেতু আর নষ্ট টয়লেটের ছবিই বারবার ফিরে আসবে।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
পঙ্কজ মিশ্র: ভারতীয়ঔপন্যাসিক।

No comments

Powered by Blogger.