মুনাফা হয়, ডলারের দাম বাড়ে তবু ধুঁকছেন পোশাক শ্রমিকরা by আবুল কাশেম

পোশাক রপ্তানিকারকরা কমপক্ষে ১০ শতাংশ মুনাফা করেন। শুধু ডলারের দাম বাড়ার কারণেই মালিকরা মুনাফা করেছেন অতিরিক্ত সাত হাজার কোটি টাকা। এ হিসাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। তবে গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা লোকসানের অজুহাত দিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়াচ্ছেন না। ফলে দেখা দিচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ।


এদিকে কোনো কোনো মালিক শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি দিচ্ছেন বা দেওয়ার বিষয়টি সমর্থন করছেন। তবে তাঁদের ভালো চোখে দেখে না মালিকদের দুটি ট্রেড ইউনিয়ন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। সংগঠন দুটির আশঙ্কা, এক কারখানার শ্রমিকরা বেশি মজুরি পেলে অন্য কারখানায় অস্থিরতা দেখা দেবে। তাই কোনো কোনো মালিক চাইলেও শ্রমিকদের বেশি মজুরি দিতে পারছেন না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন সংসদে বাজেট পেশের পর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন, পোশাক রপ্তানিকারকদের এখন রপ্তানিমূল্যের ওপর কমপক্ষে ১০ শতাংশ মুনাফা রয়েছে। আর শুধু ডলারের দাম বাড়ার কারণেই মালিকরা মুনাফা করেছেন অতিরিক্ত সাত হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে পোশাক শিল্পের ওপর ১.২০ শতাংশ উৎসে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি আরো বাড়ানো উচিত ছিল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি অর্থবছরে ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমে যাওয়ায় অতিরিক্ত সাত হাজার কোটি টাকা মুনাফার পুরোটাই মালিকদের পকেটে ঢুকেছে। তাতেও কোনো লাভ হয়নি শ্রমিকদের। গত অর্থবছরের উচ্চ প্রবৃদ্ধি, ডলারের দাম বাড়ার কারণে পাওয়া বাড়তি সুবিধার কথা মুখে না এনে মালিকরা বরাবরের মতোই বলছেন, রপ্তানি অর্ডার কমে গেছে, প্রবৃদ্ধি কমেছে, উৎসে কর বাড়ছে। আরো আছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। মালিকরা এসব অজুহাত দিলেও বাস্তবতা হচ্ছে, গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪১ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের দামও বাড়ে।
পোশাক রপ্তানিকারদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দিকে না গিয়ে শ্রমিকদের বাড়িওয়ালাদের উদ্দেশে বলেছেন তাঁরা যেন ভাড়া না বাড়ান। একই অনুরোধ করেছেন আশুলিয়া-সাভার এলাকার সংসদ সদস্য তৌহিদ জং মুরাদও। তবে সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএর এসব আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার কথা তাৎক্ষণিকভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন বাড়ির মালিকরা। বিজিএমইএ বলেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে আসায় শ্রমিকদের খাদ্যের পেছনে খরচও কমছে। বিজিএমইএর এ হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। কারণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ থেকে কমে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশে এসেছে। মূল্যস্ফীতি কমার বিজিএমইএর এই তত্ত্ব মতেই, গত বছর যে পরিমাণ খাদ্য কিনতে ১০০ টাকা লাগত, এখন তা কিনতে ১০৯ টাকার বেশি লাগছে। আর ২০১০ সালের জুলাইয়ে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণের পর ২০১১ সালেও ১০ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি ছিল। অর্থাৎ নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণের সময় ১০০ টাকায় যে পরিমাণ খাদ্য কেনা যেত, এখন তা কিনতে ১২০ টাকারও বেশি খরচ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের।
দেশের নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি ও বিশিষ্ট গার্মেন্ট ব্যবসায়ী এ কে এম সেলিম ওসমান গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গার্মেন্ট ব্যবসায় প্রচুর লাভের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের আর কোনো ব্যবসায় এত বেশি লাভ করার সুযোগ নেই। এটা চরম সত্য কথা। আমি নিজে সাড়ে ৬ শতাংশ মুনাফা নিয়ে গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করেছিলাম। একটা সময় আমি শতকরা ২৫ টাকাও মুনাফা করেছি। একসময় ১০ শতাংশ মুনাফা হতো। তবে এখন সে সুযোগ নেই। তাই শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও তার উপায় থাকে না।'
শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক না, আবার অযৌক্তিকও না- এ মন্তব্য করে সেলিম ওসমান বলেন, রাজনৈতিকভাবে আশুলিয়ায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। মজুরি বাড়ানোর দাবি এ খাতের সাধারণ শ্রমিকদের দাবি নয়। ভাঙচুর ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানও নেই। একমাত্র মালিক ও শ্রমিকের মধ্যকার আলোচনাই সমস্যা সমাধান করতে পারে। তবে শ্রমিকদের কথাও চিন্তা করতে হবে। কোনো মালিকই শ্রমিক ছাড়া টিকে থাকতে পারবেন না। তাই কারখানা বন্ধ করে দেওয়াও কোনো সমাধান নয়।
বিকেএমইএর সভাপতি অবশ্য নিজে শ্রমিকদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ারই চেষ্টা করছেন। এ কে এম সেলিম ওসমান গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, মজুরি কাঠামো অনুযায়ী শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও তিনি নিজের কারখানায় চাকরি করা শিক্ষানবিশ শ্রমিকদেরও তিন হাজার ৬৫০ টাকা মজুরি দেন। প্রতিদিন দুপুরে সব শ্রমিককে বিনা মূল্যে খাবার দেন। প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক-কর্মকর্তাকে নিজস্ব খরচে হজে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদের মালিকানাধীন আশুলিয়ার হা-মীম গ্রুপের কার্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। ওই দিন এ কে আজাদ ব্যক্তিগতভাবে মতামত দিয়ে বলেন, তিনি মনে করেন, পোশাক শিল্প শ্রমিকরা যে মজুরি পান, তা দিয়ে শ্রমিকদের জীবন চলে না। এই মজুরি আরো বাড়ানো উচিত। এ কে আজাদের এই ঘোষণাকে ভালোভাবে দেখছেন না বিজিএমইএর কোনো কোনো নেতা।
বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ কে আজাদ নিজের কারখানার শ্রমিকদের মজুরি বাড়ালে পাশের অন্য কারখানার শ্রমিকরাও তাদের মালিকদের কাছে বাড়তি মজুরির জন্য চাপ দেবে। এতে বিশৃঙ্খলা আরো বাড়বে।' প্রায় বছর দুই আগে কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কে আজাদ তাঁর কারখানার শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড চালুর পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। জানা যায়, ওই সময়ও আজাদের বক্তব্যকে ভালোভাবে নেয়নি বিজিএমইএ। অর্থাৎ কোনো মালিক এককভাবে শ্রমিকদের প্রয়োজনে বা কল্যাণের কথা চিন্তা করে বাড়তি কিছু করার কথা ভাবলেও প্রায়ই মালিকদের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১০ সালের জুলাই মাসে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার এস এম ছাইফুল্লাহ খালেদ নামে কালের কণ্ঠের একজন পাঠক তাঁর মতামতে বলেছিলেন, 'তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের নূ্যনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে তিন হাজার টাকা। এ সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। যেহেতু বর্তমানে একজনের জন্য এক দিনের দুই বেলা ভাত ও সকালের নাশতা করতে নূ্যনতম ৪০+৪০+২০=১০০ টাকা প্রয়োজন। সুতরাং প্রতিদিন শুধু খাবারের জন্য ১০০ টাকা হলে প্রতি মাসে লাগে তিন হাজার টাকা। এরপর? বাসা ভাড়া ৮০০ টাকা ধরা হয়েছে, এটি অযৌক্তিক। ঢাকা তো দূরের কথা, চট্টগ্রামেই ৮০০ টাকায় কোনো বাসা পাওয়া যায় না। যাতায়াত খরচের কোনো উল্লেখ নেই। দ্রব্যমূল্য যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি হয়নি।'
নতুন শ্রম আইনে পোশাক শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা এক ঘণ্টা কমিয়ে সাত ঘণ্টা নির্ধারণে সরকারের প্রস্তাবের বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছে বিজিএমইএ। তারা সরকারকে সম্প্রতি লিখিতভাবে জানিয়েছে, শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা আট থেকে সাত ঘণ্টা করা হলে পোশাক শিল্পে দৈনিক প্রায় ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা কমবে। দেশের মোট শ্রমিক শ্রেণীর গড় উৎপাদন ঘণ্টায় ২০ টাকা হলেও দৈনিক এক ঘণ্টা কম কাজ করলে উৎপাদন ঘাটতি হবে আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকার। তাতে শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে দৈনিক প্রায় ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকার উৎপাদন কম হবে। তাই 'কর্মঘণ্টা কমানোর বিষয়টি সস্তা আবেগ দিয়ে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় অর্থনীতি ও গণিতের মেধা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে' বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.