পারিবারিক সহিংসতা-নারী নির্যাতন ও সমাজের ‘সহিষ্ণুতা’ by রোকেয়া কবীর

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গত ২৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে অপরাধসংক্রান্ত যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, সে খবর পরের দিন বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে। এতে ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন সংঘটিত অপরাধগুলোর একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটে, যা পত্রিকায় প্রকাশ পায় না বা থানায় লিপিবদ্ধ হয় না।


সরকারি এই হিসাবে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে মোট ১৭ হাজার ৫৭৭টি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং এর সিংহভাগই ঘটেছে নারীর বিরুদ্ধে। আমাদের সময় পত্রিকার গত ২৮ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারী নির্যাতন সাত হাজার ২৮৫, ধর্ষণ এক হাজার ৫৮৬, অর্থাৎ আট হাজার ৮৭১টি অপরাধই নারী নির্যাতনসংক্রান্ত। এ ছাড়া ঘটেছে ৫০টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা, তার মধ্যে দুএকটি ছাড়া সবই নারীর বিরুদ্ধে। পাশাপাশি শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৭৫৪টি; এর অর্ধেকও যদি ধরি, তবে ৩৭৬টিই হয়েছে কন্যাশিশুর ওপর। সংখ্যার দিক থেকে নারী নিপীড়নের সংখ্যাই সবার শীর্ষে!
প্রতিবেদনটি যখন সংসদে পেশ করা হচ্ছে, তখন পারিবারিক নির্যাতনবিরোধী একটি আইন প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলছে। ২ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা)’ বিষয়ক খসড়া বিল সংসদে উপস্থাপনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৯ আগস্ট ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’ বিভিন্ন নারী, মানবাধিকার এবং শিশু সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে এই খসড়া আইন নিয়ে পর্যালোচনায় বসে এবং চূড়ান্ত করার আগে কিছু মতামত বা পরামর্শও গ্রহণ করে। আশা করা যায়, খসড়া আইনটি অতি শিগগির সংসদের অনুমোদন নিয়ে আইনে পরিণত হবে। আইনটি কার্যকর হলে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে নারীর বিরুদ্ধে যে নির্যাতন সংঘটিত হয়, তা আর ‘পারিবারিক বিষয়’ বলে পার পাওয়া বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া সহজ হবে না, এটাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত লুকানো বা নীরব অপরাধগুলোও জনসমক্ষে চলে আসবে। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নিয়ত যে নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হচ্ছে সে ব্যাপারে আমাদের উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। একশ্রেণীর মানুষ নারী নির্যাতনবিরোধী আইনের অপব্যবহার হয় বলে প্রতিবাদী কণ্ঠ থামিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের বক্তব্য হলো, এ জন্য আইনটির প্রয়োগ তথা এ আইনের অধীনে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ‘কড়াকড়ি কোনো ব্যবস্থা না রাখা’ অর্থাৎ ‘জেল-জরিমানার পরিমাণ কম রাখা’ অথবা ‘অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর ওপর রাখা’, ‘মিথ্যা মামলার শাস্তি অনেক বেশি রাখা’ ইত্যাদির মতো বিধান রাখা উচিত। যাঁরা এসব যুক্তি সামনে আনেন, তাঁরা ভুলে যান যে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইন, সম্পত্তিসংক্রান্ত আইন, বিবাহসংক্রান্ত আইন বা অন্যান্য আইনেরও অপব্যবহার হয়। এসব আইনের অপব্যবহারের কারণ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় অপরাধের সাজা কম রাখা বা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহজেই জামিন দেওয়ার পক্ষে কেউ ওকালতি করেন না। কিন্তু নারী নির্যাতন বা নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ অন্যান্য অপরাধের তুলনায় দ্বিগুণ বা তিন গুণ হওয়া সত্ত্বেও নারী নির্যাতনবিরোধী আইনের অপব্যবহারের অজুহাত অনেকেই তোলেন এবং বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
বিদ্যমান অন্য যেকোনো আইনের মতোই এ ক্ষেত্রেও অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কাকে হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই বলে ধারাবাহিকভাবে, বয়স-শ্রেণী-পেশা ও শহর-গ্রাম নির্বিশেষে নারীর বিরুদ্ধে ব্যাপক আকারে যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তা প্রতিরোধে কঠোর আইন করা যাবে না, এটা বলা কোন ধরনের মানসিকতা? সংখ্যায় সর্বোচ্চ এবং নতুন নতুন মাত্রায় এসব অপরাধকে প্রতিরোধ করতে হলে সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে এসব অপরাধের প্রতি ‘সহিষ্ণুতা’র মাত্রা কমাতে হবে।
সংসদে উত্থাপিত অপরাধসংক্রান্ত ছয় মাসের হিসাবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক রয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং এর বাইরে থেকে যাওয়া ঘটনার মিলিত সংখ্যায় নারী যে এসব অপরাধের সর্বাধিক শিকার হন, তা অনস্বীকার্য। আমাদের সামগ্রিক সামাজিক অবস্থায় ও সাংস্কৃতিক মননে পুরুষতান্ত্রিক যে আধিপত্য রয়েছে, তা নারীকে অধস্তন করে রাখার জন্য একটি শারীরিক ও মানসিক ভীতির মধ্যে ঠেলে দেয়। এ অবস্থার পরিবর্তন না করে কোনো সমাজ গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সংগত হতে পারে না।
আমরা প্রায়ই লক্ষ করে থাকি, অপরাধ প্রতিরোধের কথা উঠলেই সমাধান হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন ধরনের প্রযুক্তি ও সরঞ্জামাদি সংগ্রহের কথা বলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব প্রয়োজনকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নারীর প্রতি অপরাধ বা সামগ্রিকভাবে সমাজে সংঘটিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সন্দেহাতীতভাবে প্রয়োজন অপরাধের সামাজিক ভিত্তিকে নির্মূল করা। নারীর প্রতি সংঘটিত ক্রমবর্ধমান অপরাধ ও সহিংসতা রোধ শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও সরঞ্জাম-প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক সমাজের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে প্রশাসন, বিচার ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গির বিলোপ সাধন। বিদ্যমান অপরাধগুলোর প্রতি ‘সহিষ্ণুতা’ দেখানোর, আড়াল করার বা ‘ব্যক্তিগত’ ও ‘ছোটখাটো’ বিষয় হিসেবে অবহেলা করার পেছনে রয়েছে নারী নির্যাতনকে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ থেকে বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি। প্রস্তাবিত ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা)’ আইনটি গৃহীত ও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে নারী নির্যাতনের প্রতি সমাজের ‘সহিষ্ণু’ মনোভাবের পরিবর্তন এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক সামাজিক চেতনা বিকাশ লাভ করবে বলে আশা করা যায়।
 রোকেয়া কবীর: বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.