অরণ্যে রোদন-আমরা করব জয়, একদিন... by আনিসুল হক

‘আনিসুল, খুব খারাপ। আমি দেখলাম, বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে ধরাশায়ী করেছে। নিশ্চিত করো, আর যেন এমনটা না ঘটে। তা না হলে আমি কিন্তু আমার রুমে লুকিয়ে থাকব, আর বেরই হব না। অভিনন্দন। দিনটা ভালো যাক তোমার।’


নিউজিল্যান্ডের কিশোর-উপন্যাস লেখক ডেভিড হিল অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। ১২টা দেশে সাতটা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর বইয়ের সংখ্যা ২৭। প্রবীণ এই ভদ্রলোক সদালাপী আর রসিক। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া সিটিতে লেখকদের আবাসিক কর্মশালায় অংশ নিতে এসে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। একই ভবনে থাকি আমরা, প্রাতরাশের টেবিলে দেখা হয়।
বাংলাদেশ যেদিন দ্বিতীয়বারের মতো হারাল নিউজিল্যান্ডকে, একদিনের ক্রিকেটে, সেদিন ডেভিড হিল আমাকে এই ই-মেইল পাঠিয়েছিলেন। তার আগে, যেদিন প্রথমটায় বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছিল, সেদিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই বললাম, ‘ডেভিড, আমি তোমাকে খুঁজছি।’ উনি হেসে বললেন, ‘আমি জানি, আমি জানি। বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে।’
হিলকে ই-মেইলে জবাব লিখলাম, ‘আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বাংলাদেশ আর জিতবে না।’
কিন্তু কথা না রাখতে পারাও মাঝেমধ্যে খুব মধুর হয়ে পড়ে। নিউজিল্যান্ড থেকে ডেভিডের স্ত্রীও এসেছেন দিন তিনেকের জন্য বেড়াতে। ভোরবেলা আমি আমার রুমের জানালা দিয়ে আইওয়া নদীর দিকে সানন্দে তাকিয়ে আছি। ওই যে সেতুর ওপর দিয়ে ডেভিড দম্পতি হাঁটছেন। কাল রাতে, সারা রাত খেলা দেখেছি ইন্টারনেটে ইএসপিএন থ্রিতে, বাংলাদেশ ৩-০ হয়ে গেল। সিরিজ জয় করল ডেভিডের দেশকে হারিয়ে। ডেভিড ই-মেইলে লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় ক্রিকেটে আর আমরা তোমাদের হারাতে পারব না। রাগবি ফুটবল খেলতে হবে তোমাদের সঙ্গে।’
বাংলাদেশে খেলা হয় দিনের বেলা, আমেরিকায় সেটা রাত। শেষ ওয়ানডে শুরু হলো রাত ১০টায়। যথারীতি কম্পিউটারে সরাসরি খেলা দেখছি। বাংলাদেশ ১৭৪ করল মাত্র। দূর! আবার সেই পুরোনো বাংলাদেশ। শুয়ে পড়লাম।
গভীর রাতে দেশ থেকে ফোন। মেরিনার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, ‘১৫ রানে নিউজিল্যান্ডের তিন উইকেট পড়ে গেছে। কী, তুমি ঘুমাও! ওঠো। জিতবে বাংলাদেশ।’
নিউজিল্যান্ড বড় দল। ১৫ রানে তিন উইকেট পড়লেও ১৭৪ তারা করতে পারবে না, এটা হয় না। কাল আমাকে এখানকার বিখ্যাত প্রেইরি লাইট বইবিতানে নিজের বই থেকে পড়ে শোনানোর অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হবে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমরা যারা দর্শক, তাদের মতো সুবিধাবাদী আর হয় না। বাংলাদেশ যখন খারাপ করতে থাকে, আমরা সহজেই তখন টেলিভিশন থেকে মুখ সরিয়ে নিতে পারি। এমনও হয়েছে, বাংলাদেশ টেস্টে ইনিংস হার হেরেছে। আমরা সবাই নিজ নিজ কাজে মনোনিবেশ করেছি, কোথাও যে খেলা হচ্ছে, আমরা যেন জানিই না। কিন্তু এই হাড় লিকলিকে খেলোয়াড়েরা অন্য দেশের দৈত্যকায় খেলোয়াড়দের পাশে যেন লিলিপুট, ওরা তো আর খেলার মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে না, ওদের খেলেই যেতে হয়েছে।
৪ নম্বরটায় আর হবে না, তার চেয়ে ঘুমিয়ে নেওয়া ভালো ভেবে আমি ঘুম দিলাম। সকালবেলা বিছানাতেই হাত বাড়িয়ে ক্রিকইনফো ডট কমে ঢুকে দেখি এই আশ্চর্য সুসংবাদ, বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে ঝেঁটিয়ে পরিষ্কার করার কাজটা সম্পূর্ণ করেছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পরিষ্কার আকাশে সূর্য আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ইস, কী খেলাটাই না মিস করেছি!
প্রথম আলোর ওয়েব পাতায় গেলাম। যেন আমাকে খোঁচানোর জন্যই লিখেছে। ‘এমন শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ না দেখে থাকলে বড় একটা মিস করে ফেলেছেন। শেষ ওভারে নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ৮ রান, আর বাংলাদেশের চাই মাত্র একটা উইকেট। সাকিব বল তুলে দিলেন রুবেল হোসেনের হাতে। প্রথম বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ম্যাচ নিউজিল্যান্ডের দিকে নিয়ে গেলেন মিলস। পুরো গ্যালারি যেন নিস্তব্ধ। দ্বিতীয় বলে কোনো রান হলো না। চার বলে নিউজিল্যান্ডের চাই মাত্র ৪ রান। কিন্তু নাটকীয়তার চূড়ান্ত পর্যায়টা তখনো বাকি। তৃতীয় বলটি করতে এলেন রুবেল। ব্যাটে লাগাতে পারেননি মিলস, রুবেলের বল সরাসরি আঘাত হেনেছে স্ট্যাম্পে।’ ক্রিকইনফো লিখেছে, ‘আনন্দ উল্লাসের বজ্রে তা যেন বিদ্যুতের ঝলক লাগিয়ে দিল।’
ডেভিডের সঙ্গে দেখা হবে, এই আশায় গেলাম প্রাতরাশ কক্ষে। তিনি এলেন। আমার মুখের হাসি ঠিক দুকান পর্যন্ত নিশ্চয়ই বিস্তৃত দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘আমার এক বন্ধু আছে, যে রাগবি ফুটবলের নির্বাচক। তাকে আমি লিখছি, বাংলাদেশের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড যদি জিততে চায়, একটা রাগবি খেলার আয়োজন যেন তারা করে।’
তারপর বললেন, ‘শ্রীলঙ্কা যখন প্রথম টেস্ট মর্যাদা পায়, তখন শুধুই হারত। তারপর একদিন তারা নিউজিল্যান্ডকে একদিনের ক্রিকেটে হারিয়ে দিল। পুরো ক্রিকেট-বিশ্ব নড়েচড়ে বসল। তোমাদের বেলাতেও তা-ই হবে দেখবে। তোমাদের বিজয়ের দিন শুরু হলো।’
সত্যি তো! আমাদের বিজয়ের দিন শুরু হলো তো! সত্যি, এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো আমাদের কত বড় অনুপ্রেরণাই না দিচ্ছে। অন্য দেশের খেলোয়াড়দের পাশে আমাদের ছেলেগুলো যখন দাঁড়ায়, অনুপাতের তারতম্যটা কী রকম চোখে পড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটার মানুষ আমরা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, শিল্পকলা-বিজ্ঞান, টাকা-পয়সা কোনো একটা দিকেও আমরা এগিয়ে আছি, জোর গলায় বলতে পারব না, অথচ এ দেশের এই তরুণেরা হারিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর বড় বড় দেশকে। সাকিব আল হাসান আর তাঁর বাহিনীকে আমরা কী বলে যে অভিনন্দন জানাব।
আর ওদিকে বাংলাদেশ যখন নিউজিল্যান্ডকে হারাতে শুরু করেছে ওডিআইতে, তখন উইজডেন-এ বছরের সেরা টেস্ট ক্রিকেটার নির্বাচিত হলেন আমাদের তামিম ইকবাল। শচীন টেন্ডুলকার নন, জ্যাক ক্যালিস নন। দ্বিতীয় হওয়া গ্রায়েম সোয়ান নন, তৃতীয় হওয়া বীরেন্দ্র শেবাগ নন। আমাদের চট্টগ্রামের ছেলে তামিম, যাকে এখন বলা হচ্ছে সবচেয়ে স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান।
তার মানে আমরাও পারি। তার মানে আমরাই পারি। তার মানে আমাদের তরুণেরা পারে। আমাদের সুযোগ দিন। পথের বাধা সরিয়ে নিন, আমাদের এই তরুণদের এগোতে দিন। এরা সমস্ত পৃথিবী জয় করে এনে দেবে আপনাদের।
আজকে কেন যেন মনে পড়ছে সেসব দিনের কথা। যখন আইসিসি ট্রফিতে খেলতে যেত বাংলাদেশ। আমরাও তখন তরুণ ছিলাম। উৎপল শুভ্র বোঝাতেন আমাদের, চ্যাম্পিয়ন হলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে। আমরা রেডিওতে ধারাবিবরণী শুনতাম, বাংলাদেশ যেদিন কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হলো, রেডিওতে সেই খেলার ধারাবিবরণী শুনে সমস্ত বাংলাদেশ রাস্তায় নেমে এসেছিল।
২০০৫ সালের দিকে প্রথম আলোর সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার নিতে হোটেল শেরাটনে এসে খালেদ মাসুদ পাইলট তাঁর জীবনের একটা গল্প শুনিয়েছিলেন। ‘১৯৯৭ সালের কথা। খেলা হচ্ছে মালয়েশিয়াতে। কোয়ার্টার ফাইনাল। বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয় ঘটছে। পাইলট মাঠে নামলেন ব্যাট হাতে। আজ যদি বাংলাদেশ হেরে যায়, তাহলে সব শেষ। এখানেই বিদায়। ওডিআই মর্যাদা, টেস্ট মর্যাদা তো পরের কথা। পাইলট বললেন, হে খোদা, আজকের খেলায় আমাদের জিতিয়ে দাও। এর বদলে তুমি যা চাও, নিয়ে নিয়ো। আমার কোনো প্রিয় জিনিস, আমার সবচেয়ে প্রিয়জনকেও যদি তুমি নিতে চাও...’
দেশপ্রেম একটা আশ্চর্য জিনিস। আমাদের ক্রিকেটাররা যখন খেলেন, দেশের জন্য খেলেন। দেশের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতেও তাঁরা প্রস্তুত।
তবে প্রতিদিন তাঁদের সমান যায় না। কোনো দিন তাঁরা ভালো করেন। কখনো খারাপ করেন। ভালো করলে তাঁদের আমরা মাথায় তুলে নাচি। কিন্তু তাঁরা খারাপ করতে শুরু করলে আমরা এমন ভাব করি, ক্রিকেটট্রিকেট কোথাও হচ্ছে নাকি। আমাদের পক্ষে সহজেই অন্য কাজে মন দেওয়া সম্ভব হয়। ওরা মাঠে থাকে, হারুক জিতুক শেষ পর্যন্ত ওদের মাঠেই থাকতে হয়। জাতীয় জীবনের কোনো একটা ক্ষেত্রে যদি আমরা বিশ্বমানের সফলতা দেখাতে পারতাম, তাহলে ক্রিকেটারদের কাছ থেকে এই চাওয়ার একটা ভিত্তি দেখাতে পারতাম। শারীরিক শক্তি দরকার, আমরা এসব ক্ষেত্রে ততটা ভালো করব, সেটা কঠিন। আমাদের পারতে হবে সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতায়, বুদ্ধির খেলায়। অথচ আমরা সেসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি। ক্রিকেট সেই তুলনায় আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। এই সাফল্য-তৃষিত জাতিকে সে মাঝেমধ্যেই আনন্দের উপলক্ষ এনে দিচ্ছে। আমাদের ক্রিকেটারদের ভালোবাসা জানানোর কোনো ভাষাই আমি আজ খুঁজে পাচ্ছি না।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সক্রেটিস আর প্লেটোর সংলাপের সারকথাটা তুলে ধরেন এভাবে: প্লেটো জিজ্ঞেস করলেন, সর্বোচ্চ দেশপ্রেম কী? সক্রেটিস উত্তর দিলেন, সবচেয়ে সুন্দরভাবে নিজের কাজটুকু করা। সেটা আমরা করছি কি না, নিজের বিবেকের কাছে জবাব দিতে পারি না। শিল্প-সাহিত্যচর্চার জন্য টাকা-পয়সা লাগে না, শারীরিক শক্তি লাগে না। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও আমরা কি সর্বোচ্চ উৎকর্ষ অর্জনের জন্য আত্মনিবেদন আর সাধনার প্রমাণ রাখছি! আমাদের জাতীয় সাহিত্য কি আন্তর্জাতিক মানের?
তবুও প্রাকৃতিক সম্পদহীন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিত্য শিকার, বহু বছর ঔপনিবেশিক শেকলে বন্দী থাকা দেশটা বহু ক্ষেত্রে ভালো করছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা এগিয়ে যাবই। আমাদের তরুণেরা সর্বক্ষেত্রে এই ধরনের সাফল্য বয়ে আনতে পারে। যদি না আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি—চারদিকেই কিন্তু একটা কর্মযজ্ঞ চলছে।
নারীর অবস্থানের উন্নতির বিষয়ে বাংলাদেশের উন্নতিকে বিশেষভাবে প্রশংসা করা হয়েছে, একটা ওয়েবে পড়লাম।
কিন্তু সত্যি এই দূর পরবাসে বসে যখন প্রথম আলোর ওয়েব পাতা খুলি, কেমন যে লাগে। এত মন খারাপ করা খবর পড়তে হয়। কাগজের দিকে তাকাতে ভয় লাগে। ট্রেনের নিচে পড়ে কীভাবে এতগুলো লোক মরে? আবার ট্রেনে আগুন। উফ্!
আমার এই লেখাটা আমি শনিবারের মধ্যে লিখে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু আজকের লেখাটা লেখার জন্য রোববার দিনটা অপেক্ষা করলাম। কারণ মন যেন বলছিল, ক্রিকেটের ফলটা ৪-০ হয়ে যেতে পারে। তাহলে ক্রিকেট নিয়েই লিখতে পারব। সাফল্য নিয়ে লিখতে ভালো লাগে। কত আর আগুন, গুলি, হত্যা এসব নিয়ে লেখা যায়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা আমাদের বড় একটা আনন্দ আর ঐক্যের উপলক্ষ উপহার দিয়েছেন। সারা দেশের মানুষের চোখে-মুখে আজ বিজয়ের গৌরব। আমেরিকায় বসে নিউজিল্যান্ডের লেখকের সামনে বসে কফি খাচ্ছি, ওর চোখের মধ্যে আমার মুখের ছায়া পড়েছে, আমার মুখের হাসি আমি তাঁর চোখের আয়নায় দেখতে পাচ্ছি। শাবাশ, বাংলাদেশের অপরাজেয় তারুণ্য।
ম্যাচ জিতলে আমাদের ক্রিকেটাররা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা গান করেন, ‘উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে।’ আমরা করব জয়। জয় করার পরই তাঁরা এই গান করেন; যেন আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দেন, শুধু ক্রিকেট নয়, জাতীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে আমাদের আরও বহু কিছু জয় করা বাকি। সেই সব জয়ও আমরা অর্জন করবই।
 আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.