চরাচর-ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি by স্বপন কুমার দাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইন্দোবার্মা রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ ফৌজের আক্রমণে মিত্র বাহিনীর যেসব সৈন্য শহীদ হন, তাঁদের এ দেশে সমাহিত করা হয়। পরে এসব সৈন্যের কবরস্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আকর্ষণীয় ওয়ার সিমেট্রি। এসব ওয়ার সিমেট্রির একটি রয়েছে কুমিল্লার ময়নামতিতে, অপরটি চট্টগ্রাম মহানগরীর বাদশা মিয়া সড়কে।


তবে ময়নামতির ওয়ার সিমেট্রিটি বহুল পরিচিত। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি প্রতিবেশী পোল্যান্ড আক্রমণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। জার্মানির পক্ষে ছিল ইতালি, জাপান, যুগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া (অক্ষ শক্তি)। অপরদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ নিয়ে গড়ে ওঠে মিত্র বাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হয়। তখন ইংরেজরা এ দেশ শাসন করত। নেতাজি সুভাস বোস সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের শত্রু জার্মানিতে গিয়ে হিটলারের সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হয়ে জাপান চলে আসেন। তিনি রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে ভারত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি জাপানের কাছ থেকে সাহায্য লাভ করেন। আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থের অভাব থাকলেও সুভাস বোসের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সব সৈন্য ১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে সর্বপ্রথম বার্মা দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো আক্রমণ করে ভারতের ইংরেজ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে তোলে। সুভাস বোসের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের আরাকান, ইম্ফল, ময়রাং, বিষেণপুর প্রভৃতি স্থান দখল করে নেয়। এসব দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধবিমান ও কামান নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। কয়েক মাস স্থায়ী এ যুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে তাঁরা রেঙ্গুনে এসে পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে জাপানের আত্মসমর্পণ এবং নেতাজির রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ দুর্বল হয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের অনেকেই হতাহত হয়। এসব শহীদের মধ্যে কয়েক শ সৈন্যকে ময়নামতি ও চট্টগ্রামে সমাহিত করা হয়। পরে কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশন এসব সৈন্যের কবরস্থানকে ঘিরে গড়ে তোলে আকর্ষণীয় ওয়ার সিমেট্রি। কিন্তু দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের যেসব সৈন্য শহীদ হয়, তাদের স্মৃতির জন্য কোথাও গড়ে ওঠেনি কোনো স্মৃতিসৌধ। ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে রয়েছে ৭৩৭ সৈন্যের কবর। প্রতিটি স্মৃতিফলকে মৃত সৈন্যের নাম, জাতীয়তা, বয়স, র‌্যাংক লেখা আছে। এখানে মিত্র বাহিনীর যেসব দেশের সৈন্যদের কবর দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রিটিশ-ভারত। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার বেলা ১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই সিমেট্রিটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। প্রতিবছরের ৫ নভেম্বর কমনওয়েলথভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা এই সিমেট্রিতে উপস্থিত হয়ে নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন।

স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.