চিরকুট-গো যোগ এষণা by শাহাদুজ্জামান

১ অক্টোবর এই কলামে ‘বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার পাশাপাশি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করুণ দশার কথা উল্লেখ করেছিলাম। বিশেষ করে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্বল গবেষণাচর্চার কথা লিখেছিলাম। খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই লক্ষ করি, সেদিন


প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে সবচেয়ে আলোচিত সংবাদে পরিণত হয়েছে এটি। চিরকুট কলামটি নিয়ে প্রায়ই ই-মেইল পাই, কিন্তু এই নিবন্ধটির ব্যাপারে ই-মেইল পেয়েছিলাম বিপুল সংখ্যায়। আমি পাঠক-পাঠিকাদের মন্তব্যগুলো মনোযোগের সঙ্গে পড়ে এ বিষয়টিতে তাঁদের এত সক্রিয় প্রতিক্রিয়া জানানোর কারণ বোঝার চেষ্টা করি। লক্ষ করি, মন্তব্যগুলোর ভেতর একটা গভীর ক্ষোভ এবং আর্তি আছে। দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের ওপর একে একে মানুষের বিশ্বাস ধসে গেছে। দেশের বিবেক হিসেবে, জ্ঞানের পীঠস্থান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে ঐতিহাসিক ইমেজ রয়েছে, মানুষ চোখের সামনে সেটিও ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেছে। বুঝতে পারি, কলামের লেখায় সেই স্বপ্নভঙ্গের আক্ষেপের প্রতিধ্বনি দেখে লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁরা। আজকের কলামে আমার কাছে লেখা পাঠক-পাঠিকাদের কিছু নির্বাচিত মন্তব্যই তুলে ধরছি।
অনেকেই ক্রোধের সঙ্গে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় এখন জ্ঞানের নয়, দুর্বৃত্তায়নচর্চার জায়গা হয়েছে। একজন লিখেছেন, বহুদিন আগে এক কবি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ডাকাতদের গ্রাম’ বলে সমালোচিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি মনে করেন, এ কথার মধ্যে সত্যতা আছে। ছাত্র ও শিক্ষকদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক চর্চার ব্যাপারে ঘৃণা জানিয়েছেন অধিকাংশ পাঠক-পাঠিকা। কেউ কেউ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এককালের অনেক স্বনামধন্য শিক্ষকের নাম এবং তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, সে বিবেচনায় এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে তাঁর লজ্জা হয়। অনেকে তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন কী করে শিক্ষকেরা গবেষণাকে সময় অপচয় বলে মনে করেন; বরং সে সময়টিতে কোনো রাজনৈতিক দলের সেবা করাকে বিবেচনা করেন অনেক লাভজনক বলে। এক পাঠক অনেক অধ্যাপকের উদাহরণ দিয়ে লিখেছেন, তাঁরা গবেষণা তো দূরের কথা, ছাত্রদের কোনো ক্লাসও নেন না। অথচ তিনি রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক সম্মান ভোগ করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বর্তমান ছাত্র লিখেছেন কী করে তাঁদের শিক্ষকেরা ছাত্রদের করা গবেষণা নিজেদের নামে চালিয়ে দেন। কয়েকজন লিখেছেন কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা তাঁদের ২০ বছর আগের হলুদ হয়ে যাওয়া পুরোনো লেকচার নোট দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েও শিক্ষকতার সুযোগ না পাওয়ার কাহিনি লিখেছেন একজন। আবার একজন লিখেছেন, কী করে জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পর্কহীন দুর্ধর্ষ এক ছাত্রনেতাকে নেহাত দলীয় বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করে নেওয়া হয়েছে।
বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেইল করে জানিয়েছেন, সীমিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাচর্চা হচ্ছে, তাঁরা বরং গবেষণার প্রতিবন্ধকতাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা লিখেছেন, গবেষণা করার জন্য যে ন্যূনতম অর্থ, লোকবল বা প্রণোদনা দরকার, তার বিন্দুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই। একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, তিনি একসময় বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন; পরে চলে যান মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে। তিনি জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ায় শিক্ষকতা করার পাশাপাশি প্রতি মাসে বেতনের বাইরে শুধু গবেষণা করার জন্য একটা মোটা অঙ্কের টাকা তাঁকে দেওয়া হয়। অথচ দেশে থাকতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে গবেষণার জন্য একটি টাকাও তিনি জোগাড় করতে পারেননি। এক শিক্ষক একটি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের যত বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক আছেন, তাঁদের সবাইকে গবেষণার জন্য বছরে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দিলে মোট খরচ হবে ৫০ কোটি টাকা। হঠাৎ শুনে পরিমাণটি বিশাল মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি জানাচ্ছেন পত্রিকা মারফত জানা গেছে, শুধু রোজার মাসে ঈদ বাবদ বাজারে কেনাকাটা হয়েছে ২০-৩০ হাজার কোটি টাকার। অপর এক শিক্ষক লিখেছেন, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন লজ্জাজনকভাবে কম এবং তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিম্নতম। তিনি লিখেছেন, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রভাষকের বেতন কোনো কোনো বহুজাতিক কোম্পানির ড্রাইভার, পিয়নের চেয়েও কম। এক পাঠক জানিয়েছেন, টাইম ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকলেও ভিন্ন একটি সংস্থার তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান ৫৫০ থেকে ৬০০-এর মধ্যে রয়েছে। অবশ্য এই মেধাস্থান খুব বিশেষ কোনো আনন্দের সংবাদ কি না, তা ভাবার বিষয়। সাধারণভাবে আমাদের সমাজে জ্ঞানবিমুখতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলাম, তাকে যথার্থই বলেছেন অধিকাংশ। একজন পাঠিকা জানিয়েছেন তাঁর জানামতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিদেশি দূতাবাসগুলোতে যে পরিমাণ গবেষণা রিপোর্ট রয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তো দূরের কথা, এমনকি কোনো দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানেরও তা নেই। ফলে স্বভাবতই আমাদের রাজনীতি নিয়ে তাঁদের জ্ঞান আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং তাঁরাই যে আমাদের রাজনীতির কলকাঠি নাড়বেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী?
একজন পাঠকের কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্য দিয়ে ইতি টানব। তিনি লিখছেন, ‘গবেষণা’ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় ‘গো যোগ এষণা’। গো অর্থাৎ গরু, এষণা অর্থাৎ অনুসন্ধান। আক্ষরিক অর্থে ‘গরু খোঁজা’। সন্দেহ নেই, গরু হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পেতে কৃষককে বেশ খানিকটা গবেষণা করতেই হয়। সেই পাঠক বলেছেন, সামগ্রিকভাবে আমাদের গবেষণার মান ওই গরু খোঁজার স্তর থেকে খুব একটা ওপরে উঠেছে বলে মনে হয় না।
 শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.