বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪২৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ শেখ দিদার আলী, বীর প্রতীক বীর শহীদ ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধ। শেখ দিদার আলীসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে কয়েক দিন আগে বাংলাদেশে এসেছেন।


তাঁদের অবস্থান কুষ্টিয়ার সদর উপজেলায় (তখন থানা) গোপন এক শিবিরে। একদিন তাঁরা খবর পেলেন, তাঁদের এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল এসে গ্রামবাসীকে নির্যাতন করছে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের শক্তি সম্পর্কে জানেন না। আক্রান্ত গ্রামবাসী মারফত ভাসা ভাসা খবর পেয়েছেন তাঁরা। শত্রু সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে তাদের আক্রমণ করা বিপজ্জনক। কিন্তু গ্রামবাসীর বিপদে তাঁরা বসে থাকতে পারেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করলেন। শেখ দিদার আলীসহ তাঁর সব সহযোদ্ধা এ ব্যাপারে একমত হলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র বলতে এসএলআর, স্টেনগান আর রাইফেল। এ ছাড়া কয়েকটি গ্রেনেড। গুলির সংখ্যাও সীমিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণ করলে বেশিক্ষণ তা মোকাবিলা করার শক্তি তাঁদের নেই। এতে তাঁরা মনোবল হারালেন না। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে রওনা হন অকুস্থলে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা মুখোমুখি হলেন পাকিস্তানি সেনাদের। পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকার মিলে সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি। সবাই এক স্থানে সমবেত। তারা নিরীহ গ্রামবাসীকে অত্যাচার-নির্যাতন করে তখন শহরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আয়োজন করছে। তাদের সঙ্গে আছে কিছু স্থানীয় দোসরও। অর্থাৎ রাজাকার।
গ্রাম থেকে লুটপাট করা অনেক মালামাল সেখানে স্তূপ করে রাখা। তিন-চারজন রাজাকার পাহারায়। আর পাকিস্তানি সেনারা লুটপাট করা মালামাল নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারায় ব্যস্ত। এতক্ষণ কোনো বাধা না পেয়ে তারা সবাই শিথিল অবস্থায়। মুক্তিযোদ্ধারা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ চালালেন।
আকস্মিক আক্রমণে হকচকিত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা। তবে তারা বিশেষত পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের সামলিয়ে নিমিষেই পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারা এতে দমে গেলেন না। সীমিত সম্বল নিয়েই পাকিস্তানি আক্রমণ বিপুল বিক্রমে মোকাবিলা করতে থাকলেন। মুখোমুখি যুদ্ধ চলতে থাকল।
বৃষ্টির মতো গুলি করছে পাকিস্তানি সেনারা। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মাথা তোলা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। শেখ দিদার আলী এতে বিচলিত হলেন না। সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। কিন্তু বেশি সময় পারলেন না। হঠাৎ পাকিস্তানিদের ছোড়া গুলি এসে লাগল তাঁর বুকে। ঢলে পড়লেন মাটিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভে গেল তাঁর জীবনপ্রদীপ।
এ ঘটনা ৫ সেপ্টেম্বরের। কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার বংশিতলার কাছে দুর্বাচারা গ্রামে।
শেখ দিদার আলী পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতেন কুষ্টিয়া টেলিফোন অফিসে। ১৯৭১ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ শেষে ভারতে যান। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ৮ নম্বর সেক্টরের শিকারপুর সাবসেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ শেখ দিদার আলীকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৩৮১।
শহীদ শেখ দিদার আলীর পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার আড়ুয়াপাড়া গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম শেখ নূরুল ইসলাম, মা সুফিয়া খাতুন।
শহীদ শেখ দিদার আলীর ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮ ও স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.