খোলা চোখে-একুশ শতকের দীর্ঘতম যুদ্ধ by হাসান ফেরদৌস

বিশ শতকের দীর্ঘতম যুদ্ধটি অবশেষে শেষ হলো গত সপ্তাহে। ব্যাপারটা হয়তো আপনাদের নজর এড়িয়ে গেছে; না, আমি ইরাক যুদ্ধের কথা বলছি না। সে যুদ্ধ শেষ হয়েছে কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। আমি বলছি, প্রথম মহাযুদ্ধের কথা।


কাগজে-কলমে এই যুদ্ধ তত দিন চলবে যত দিন সে যুদ্ধের পরাজিত শক্তি জার্মানি ভার্সাই চুক্তি মোতাবেক তার ওপর ধার্য ক্ষতিপূরণের প্রতি পাই-পয়সা চুকিয়ে না দেয়। গত সপ্তাহে অবশেষে জার্মানি মোট ২২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের শেষ কিস্তি ৬০ মিলিয়ন ডলার মিটিয়ে দিয়েছে। এই টাকা আপাতত ব্যাংকে জমা রাখা হবে, পরে সময়মতো ও নির্ধারিত নিয়মে তা ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হবে প্রথম মহাযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের মধ্যে।
বিশ শতকের দীর্ঘতম যুদ্ধটি শেষ হলো বটে, কিন্তু একুশ শতকের দীর্ঘতম যুদ্ধটি তার দশম বছরে পা রাখল গত সপ্তাহেই। আমি আফগান যুদ্ধের কথা বলছি। নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আত্মঘাতী হামলার জবাবে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল অক্টোবর ২০০১ সালে। সে যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই, যদিও কোনো ফর্মুলায় যেনতেনভাবে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে সেখান থেকে পালাতে পারলে আমেরিকানরা বাঁচে। ইতিমধ্যেই তারা এক হাজার সেনা খুইয়েছে। তালেবানের পক্ষে কত লোক মারা গেছে, নিরীহ আফগানই বা কত হতাহত হলো, তার অবশ্য কোনো লেখাজোখা নেই। আর অর্থ? বুশ ও ওবামা প্রশাসন মিলে গত নয় বছর সরকারিভাবে এই যুদ্ধের জন্য এ পর্যন্ত ব্যয় করেছে ৩৩৭ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দিয়ে যদি সোনা কেনা হতো, পুরো দেশটাকেই হয়তো তা দিয়ে মুড়ে দেওয়া যেত। অথচ সত্যি কথা হলো, আফগানিস্তান এখনো বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশ। যার ৬০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর, মাথাপিছু আয় আড়াই শ ডলার; যেখানে এখনো প্রতি ১০০ শিশুর ২৬ জন জন্মের এক বছরের মধ্যেই মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে তার ৬০ শতাংশ নানা রোগে আক্রান্ত, যার ফলে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি অনিশ্চিত। কোটি কোটি ডলার ঢালার পরও দেশটি যে এখনো চরম অনুন্নত, তার একটা কারণ সে টাকা মানুষের হাতে পৌঁছানোর আগে তা লুটেপুটে নিয়ে যায় দেশের সেসব লোকজন, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে।
আফগানিস্তান নিয়ে আমেরিকার এই যে লেজেগোবরে অবস্থা, তা আমাদের পক্ষে বুঝে ওঠা কিছুটা কঠিনই বটে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ ও তার মিত্ররা মিলে প্রায় এক দশক যুদ্ধ করছে কুল্লে কয়েক হাজার তালেবানের যোদ্ধার সঙ্গে। অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত, কম্পিউটার কি তা জানে না, তাদের বিমান নেই, ট্যাংক নেই, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নেই, আধুনিক গোয়েন্দাপ্রযুক্তি নেই। তার পরও আমেরিকানদের তারা কেবল ঠেকিয়েই রাখেনি, কোনো কোনো জায়গায় তাদের পিছু হটতেও বাধ্য করেছে। একটা কারণ অবশ্য স্পষ্ট। ঠিক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধের সেরা ক্ষেত্র নয় আফগানিস্তান। সে চেষ্টা করে সোভিয়েতরা গোহারা হেরে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। দুর্গম পাহাড়ি দেশ, এই দেশে এসে আমেরিকানরা যারা তাদের ভাষা জানে না, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত নয়; তারা যত আধুনিক অস্ত্রই ব্যবহার করুক না কেন, পুরোপুরি জেতা অসম্ভব। বোমা মেরে হয়তো আজ হটানো গেল, কিন্তু দুদিন পরই পাহাড়ি গুহার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে ঠিকই বেরিয়ে এসে তারা পুরোনো জায়গা ফের দখল নেবে। খুব বিপদ হলে ছুটে পালাবে পাশের বাড়ির পাকিস্তানে। সেখানে তো বালাখানা খোলা রয়েছেই।
এই আফগানিস্তানকে নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে ওবামা প্রশাসনের ভেতর চুল ছেঁড়া শুরু হয়েছে। তাদের হাতে খুব বেশি পথও খোলা নেই। অনন্তকাল তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে না। চালকহীন ড্রোন দিয়ে পাহাড়ি এলাকায় বিমান হামলা চালানো হয়তো যায়, কিন্তু তার যে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ অর্থাৎ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি যে হারে নিরীহ পাকিস্তানিরা হতাহত হচ্ছে, তার ফলে বিপদ বাড়ছে বৈ কমছে না। পাকিস্তানের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল মাহমুদ আহমেদ আমেরিকান বন্ধুদের সে কথা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন চার বছর আগেই। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক নথিতে দেখা যায়, জেনারেল মাহমুদ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি পাকিস্তানের ভেতর বোমা ফেলে একজন পাকিস্তানিকে হত্যা করেন, তার ফলে কম করে হলেও হাজার পাকিস্তানি যুবক জেহাদে যোগ দেবে।’ তাঁর এ কথা একদম শূন্য আস্ফাালন নয়। মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সে কথার সমর্থন মিলেছে। বস্তুত, আমেরিকার সামরিক কৌশলবিদেরা এককথায় নিশ্চিত যে আফগান যুদ্ধে জিততে হলে তাদের পাকিস্তানকে হাতে রাখতে হবে। সম্প্রতি ওবামা প্রশাসন কংগ্রেসের কাছে আফগান যুদ্ধের ওপর এক দীর্ঘ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। তাতে এ কথাটা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে জেতার রাস্তাটা পাকিস্তানের ভেতর দিয়েই গেছে। কিন্তু ড্রোন হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের ভেতর শত্রু বাড়ানো হবে, আর তাতে শুধু লাভ তালেবানের।
এ কথা ঠিক যে সামরিক যুদ্ধে তালেবানরা আমেরিকাকে হারাতে পারবে না। কিন্তু শুধু সামরিক কায়দায় আমেরিকাও তালেবানের নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। তার প্রধান কারণ সময়। নিজের দেশের ওপর অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অনন্তকাল যুদ্ধ করে যেতে পারে তালেবানরা। আমরা তালেবানের মন্দ বলতে পারি, তাদের নীতির সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তারা তো বিদেশি নয়, এই দেশেরই মানুষ। ১০ বছরেই আমেরিকার নাভিশ্বাস উঠেছে, অনন্তকালের প্রশ্ন তো ওঠেই না। খোদ আমেরিকার ভেতর এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন তলানিতে এসে ঠেকেছে। রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা যদি বা তাতে অর্থ জোগান দিতে রাজি হয়ও, উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা তাতে নারাজ। এই উদারনৈতিকদের ভোটেই জিতে এসেছেন ওবামা। তাঁকে যদি ২০১২ সালে পুনর্নির্বাচিত হতে হয়, এই ডেমোক্র্যাটদের হাতে রাখতে হবেই। গত মাসে ওবামস ওয়ার নামে সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের নতুন যে বই প্রকাশিত হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে নিজের গদি সামলাতে ওবামা আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার একটা সম্মানজনক পথ খুঁজছেন। এ বছর গোড়ার দিকে আফগাননীতি নিয়ে তাঁর উপদেষ্টা ও সেনাপতিদের সঙ্গে দিনের পর দিন বৈঠক করেছেন তিনি। জেনারেলরা সবাই মত দিয়েছেন, আফগানিস্তান থেকে সরে আসা আত্মঘাতী হবে, কারণ আমেরিকানরা সরে আসার দুদিন পরই তালেবান দখল নেবে কাবুলের। কারজাই সরকারের ক্ষমতা নেই তাদের ঠেকানোর। অতএব, সে দেশ আবারও সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে। তাহলে ১০ বছর এই কোটি কোটি টাকা খরচ করে, এক হাজার মার্কিন সেনার রক্ত দিয়ে লাভটা হলো কী? কিন্তু ওবামা তাঁদের যুক্তি কানে তোলেননি। উডওয়ার্ড লিখেছেন, ওবামা জোর দিয়েছেন যত শিগগিরই সম্ভব সে দেশ থেকে মার্কিন সেনার একটা বড় অংশ সরিয়ে আনতে। ‘তা না হলে আমি ডেমোক্র্যাটদের ধরে রাখতে পারব না’, ওবামা মন্তব্য করেছিলেন। উডওয়ার্ড জানিয়েছেন, উপদেষ্টাদের প্রতি বিরক্ত ওবামা নিজেই তিন পাতার রণকৌশল লিখে পাঠান। সে রণকৌশলের মোদ্দা কথা হলো, আপাতত অতিরিক্ত সেনা পাঠানো হবে আফগানিস্তানে, কিন্তু আগামী বছরের মাঝামাঝি মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে।
তালেবানের স্মৃতি এখনো যাদের মন থেকে ম্লান হয়নি, এ কথা শুনে তাদের গায়ে জ্বর আসার কথা। তালেবান মানেই আবার সেই মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া। স্টেডিয়ামে হাজার লোকের সামনে পাথর ছুড়ে হত্যা, মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়া আটকানো, রাস্তায় ইঞ্চি মেপে দেখা দাড়ির পরিমাণ ঠিক হিসাবমতো রাখা হয়েছে কি না।
শুধু যে আফগানিস্তানের মেয়েরা সেই আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন, তা নয়। সে দেশের হাজারা ও তাজিক সংখ্যালঘুও তালেবানের ফের ক্ষমতায় ফিরে আসার আশঙ্কায় শঙ্কিত। তালেবান মানে মূলত সংখ্যাগুরু পশতুন, এদের হাতেই আফগানিস্তানের সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তালেবান সরে যাওয়ার পর সংখ্যালঘুদের অবস্থার অল্পবিস্তর পরিবর্তন হয়েছে, শাসনতান্ত্রিকভাবে তাদের অধিকার স্বীকৃতিও পেয়েছে। এ অবস্থায় সত্যি সত্যি যদি আমেরিকার দূতিয়ালিতে তালেবানের সঙ্গে কোনো ধরনের ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি সম্পাদিত হয়, তাহলে হাজারা ও তাজিক উভয় গোষ্ঠীই হয়তো বেঁকে বসবে। ফলে এক যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই সেখানে হয়তো শুরু হবে আরেক যুদ্ধ।
সে সম্ভাবনা মাথায় রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা ভাবছে আমেরিকা। যে মডেলটি তাদের সামনে আছে, তা হলো ইরাক। সে দেশটিও জাতিগতভাবে বিভক্ত, কিন্তু শাসনতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি চুক্তি হওয়ার ফলে সেখানে এক ধরনের সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আমেরিকার সেনারা সেখানে আর যুদ্ধ করছে না, কিন্তু হাজার হাজার সেনা হয়তো অনন্তকাল সেখানে থাকবে পাহারাদার হয়ে। তাদের উপস্থিতির ফলে হালকা বা মাঝারি ধরনের গৃহযুদ্ধ হয়তো লেগে থাকবে, কিন্তু পরিস্থিতি একদম আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে না। সম্ভব হলে এই একই মডেল আফগানিস্তানেও চালু করার কথা ভাবছে আমেরিকা। শুধু আল-কায়েদার প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্যই নয়, আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ যাতে হাতছাড়া না হয়, সেটাও আমেরিকা হিসাবে রেখেছে। মাস দুয়েক আগে নিউইয়র্ক টাইমস ফাঁস করেছে, আফগানিস্তানে কম করে হলেও এক ট্রিলিয়ন ডলারের অতি মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে। তার অন্যতম হলো কোবাল্ট, নিওবিয়াম, আয়রন ইত্যাদি সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই সম্পদ হাতছাড়া হোক, আমেরিকা তা অবশ্যই চাইবে না।
তা ছাড়া আফগানিস্তানের সামরিক গুরুত্বও অপরিসীম। তার গা-ঘেঁষে একদিকে রয়েছে ইরান, অন্যদিকে তেলসমৃদ্ধ সাবেক সোভিয়েতের প্রজাতন্ত্রগুলো। সোভিয়েতরা একসময় আফগানিস্তানে এসেছিল মূলত দেশটির সামরিক ও কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে। ঠিক সেই একই কারণে আমেরিকাও তার খাটানো তাঁবু এখান থেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেবে না। এমন হতে পারে যে সামরিক দায়িত্ব থেকে আমেরিকানদের সরিয়ে তাদের উপদেষ্টার ভূমিকায় নিয়োগ করা হবে। আর যুদ্ধ করার নোংরা কাজটা তুলে দেওয়া হবে খোদ আফগানদের হাতে, তাদের সঙ্গে সহচর হিসেবে থাকবে দু-চারটা মুসলমান দেশের ভাড়াটে সেনা। ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনী’জাতীয় গালভরা নাম তাদের দেওয়া হবে, কিন্তু তাদের কাজ হবে একটাই—আমেরিকার স্বার্থ পাহারা দেওয়া।
আমেরিকা থাক বা যাক, আফগানিস্তানের দুঃখরজনী খুব সহজে মিটবে বলে মনে হয় না।
 হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.