কলকাতার চিঠি-পূজার বাদ্যি কলকাতাজুড়ে by অমর সাহা

গতকাল বুধবার থেকে শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। গতকাল ছিল দেবীর মহাষষ্ঠীপূজা। এবারও দুর্গাপূজাকে ঘিরে কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ঘাটতি নেই। মণ্ডপে মণ্ডপে বেজে উঠেছে এই শারদ-উৎসবের আগমনীবার্তা। ফুটেছে সর্বত্র কাশফুল। মেঘমুক্ত আকাশ চারদিকে। সবার মনে খুশির হাওয়া।


উৎসবের আবেগে ভাসছে কলকাতা। এই আনন্দ-উৎসবের রোশনাই ছড়িয়ে পড়েছে ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খন্ড, দিল্লি, মুম্বাই, বিহার, গুজরাট, ওডিশা, ছত্তিশগড়, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের সর্বত্র। যেখানে বাঙালি সেখানে এই আনন্দ-উৎসব।
শারদীয় এই দুর্গোৎসব ঘিরে কলকাতায় মেতেছে বাঙালিরা। আবেগে ভাসছে গোটা কলকাতাই। উৎসব ঘিরে গোটা কলকাতাই হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মহামিলনক্ষেত্র। একাত্ম হয় হিন্দু-মুসলিম-শিখ-জৈন-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লাখো মানুষ। দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আর এই উৎসবের আনন্দ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতাতেই। প্রতিবছরের মতো এবারও কলকাতা আপন করে নিয়েছে দুর্গোৎসবকে। সেজে উঠেছে কলকাতা। আলোর রোশনাই ছড়িয়ে পড়েছে শহরজুড়ে। রাজপথ থেকে অলিগলিতে। এর প্রতিফলন ঘটেছে রাজ্যজুড়েই।
শুধু কি পশ্চিমবঙ্গ? যেখানে বাঙালি সেখানে শারদীয় দুর্গোৎসব। ভারতজুড়েই চলছে এই উৎসব। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে যেমন সেরা উৎসব এই শারদীয় দুর্গাপূজা, ঠিক তেমনি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের সেরা উৎসব গণেশপূজা। তামিলনাড়ুর সেরা উৎসব সূর্যদেবতাকে ঘিরে পোঙ্গল উৎসব, আসামে বিহু উৎসব ও কামাখ্যা দেবীর পূজা, ওডিশার জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব, গুজরাটের নবরাত্রি উৎসব, কেরালার ওনাম উৎসব আর উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড় ও ঝাড়খন্ডের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো জন্মাষ্টমী, রাম নবমী, দেওয়ালি বা হোলি উৎসব।
কলকাতার পূজায় এবারও চলছে সেই থিমের লড়াই সাবেকি পূজার সঙ্গে। চলছে কে কাকে টেক্কা দিতে পারে, তার প্রতিযোগিতা। সাবেকি পূজার সেই ঢং আজ অধিকাংশ পূজামণ্ডপ থেকে বিদায় নিলেও কলকাতার বেশ কিছু পূজামণ্ডপ আঁকড়ে ধরে রেখেছে সেই সাবেকি পূজার রীতিনীতি আর ঢং।
উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গার চণ্ডীতলায় এবার দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করা হয়েছে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে। হাওড়ার কোটালঘাটায় দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করা হয়েছে চাউমিন দিয়ে। লেগেছে ১০০ কেজি চাউমিন। আর এখানের মনসাতলায় দুর্গা তৈরি করা হয়েছে ঝিনুক ও শামুক দিয়ে। শিরীষ কাঠের দুর্গা তৈরি করা হয়েছে বর্ধমানের কালনায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের চাইপাটা বাজার সমিতি পূজামণ্ডপ তৈরি করেছে জ্ঞানেশ্বরী ট্রেন দুর্ঘটনার আদলে। মাত্র দুই বছর আগে কলকাতায় এই পূজার অন্যতম আকর্ষণ ছিল ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী মৈত্রী ট্রেনের আদলে গড়া পূজামণ্ডপ। সে সময় গড়া হয়েছিল প্রতীকী ময়ূরভঞ্জ নামের একটি রেলস্টেশনও। স্টেশনের শেড, টিকিট কাউন্টার, কম্পিউটারাইজড রিজার্ভেশন কাউন্টার, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরা, ইঞ্জিন, গার্ড, চালক—সবই ছিল এই মৈত্রী ট্রেনে আর স্টেশনে।
আর কলকাতা? সেখানে তো থিমের লড়াইয়ের শেষ নেই। কে কাকে টেক্কা দিতে পারে, চলছে তার প্রতিযোগিতা। কলকাতায় চলছে এবার পরিবর্তনের হাওয়া। সেদিকে লক্ষ রেখে এবার রাইটার্স বিল্ডিং বা মহাকরণের আদলে মণ্ডপ তৈরি করেছে সন্তোষ মিত্র স্কয়ার। তাতেই রাইটার্স বিল্ডিংয়ের লাল রং বদলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতার তালতলা পল্লি উন্নয়ন সমিতি এবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীকে ঘিরে পূজার থিম করেছে কবিগুরুকে নিয়ে। মণ্ডপের সামনে রাখা হয়েছে কবিগুরুর মূর্তি। কলকাতার দমদম পার্ক মণ্ডপ তৈরি করেছে সাত হাজার কেজি তোয়ালে আর হরেক রকম পুতুল দিয়ে। মণ্ডপটি হয়েছে ৪০ ফুট উঁচু একটি রথের আদলে। কাগজের মণ্ডের দুর্গা প্রতিমা এবং মণ্ডপ তৈরি করেছে নাকতলার ভ্রাতৃ মিলন সংঘ। কচ্ছের রানের আদলে মণ্ডপ তৈরি করেছে গড়িয়া বিধানপল্লি সর্বজনীন। সাইকেলের চাকা দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছে বোসপুকুর শীতলা মন্দির। ১০ লাখের বেশি চক দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছে কেন্দুয়া শান্তি সংঘ। ইস্পাতের মন্দির তৈরি করেছে কলকাতার ত্রিধারা সম্মিলনী। পূর্ব বড়িশা শীতলাতলার কিশোর সংঘ মণ্ডপ তৈরি করেছে বাঁশের বাখারি ও নকশা করা রঙিন কাপড় দিয়ে। লেজার রশ্মি আর সাইবারশিল্পের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছে নাকতলার উদয়ন সংঘ। কুমুরটুলি পার্কের পূজামণ্ডপে ফুটে উঠেছে আদিপুরাণের চার যুগ। বেলেঘাটার চাউলাপট্টির পূজামণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে রাজস্থানের সোনার কেল্লার ধাঁচে। মাটির ভাঙা কলসি আর হাঁড়ি দিয়ে মণ্ডপ তৈরি করেছে টেংড়া ঘোলপাড়া সর্বজনীন। সুরুচি সংঘের পূজামণ্ডপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মানবসভ্যতার নানা দিক। এবারের থিম কর্ণাটক।
তবে আজ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আজও কলকাতার এই দুর্গাপূজার বিকল্প নেই। কলকাতা মানে দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজা মানে কলকাতা। কলকাতা আর দুর্গাপূজা যেন সমার্থক হয়ে গেছে। কলকাতার এই দুর্গাপূজা প্রতিবছরই এনে দেয় নতুন মাত্রা। প্রতিবছর এই দুর্গাপূজাকে ঘিরে কলকাতায় শুরু হয় পূজা-জ্বর। এবারও পূজা-জ্বরে কাঁপছে গোটা কলকাতা। সর্বত্রই শুধু আলোর রোশনাই। থিমের লড়াই। পাল্টে দিচ্ছে সাবেকি পূজার সব রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণা। মণ্ডপ আর প্রতিমা নির্মাণে এসেছে আধুনিকতার ছাপ। হারিয়ে গেছে পূজামণ্ডপের সেই চৌচালা বা আটচালা ঘরের ছবি। দুর্গাপ্রতিমাও তৈরি হচ্ছে নানা রং আর নানা ঢঙে। বদলে গেছে দুর্গাদেবীর সেই সাবেকি রংও। এসেছে সেখানে নানা রং। পাল্টে গেছে মা দুর্গার বেশভূষাও। কোথাও মা দুর্গা আবির্ভূত হন হাসিমুখে, শান্তরূপে, শান্তির বারতা নিয়ে; আবার কোথাও উগ্র চণ্ডীরূপে। আবার কোথাও যুদ্ধের বেশে, প্রধান যোদ্ধারূপে।
কলকাতায় প্রথম দুর্গাপূজা হয় ১৬১০ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আটচালার মণ্ডপে। এবারও সেখানে পূজা হচ্ছে সেই আটচালার মণ্ডপেই।
এবার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দুর্গাপ্রতিমার আদলে তৈরি করেছে দুর্গাদেবীর মূর্তি বেলঘরিয়ার মানসবাগের সর্বজনীন পূজা কমিটি। গতবার বাংলাদেশের বান্দরবান বৌদ্ধমন্দিরের আদলে মন্দির তৈরি করেছিল কালীঘাটের শ্রীসংঘ।
এখন দুর্গাপূজা মানেই থিমের লড়াই। সেকাল বনাম একালের লড়াই। এই লড়াইয়ে হারিয়ে গেছে সাবেকি পূজার রীতিনীতিও। আজ কলকাতায় দুর্গাপূজা এক সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। আজকের পূজা আর আটকে নেই সেদিনের সেই চৌচালা বা আটচালা মন্দিরের বাঁধনে। ছড়িয়ে পড়েছে নানা রং আর নানা ঢঙের মন্দিরে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.