সময়ের প্রতিবিম্ব-মানুষ মরছে তাই রাজনীতি আছে by এবিএম মূসা

অতীতে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ ছিল, তারা উন্নয়নশীল দেশের শুধু দুঃসংবাদগুলো প্রচার করে। আমাদের ভালো কিছু তাদের কাছে ‘খবর’ নয়। প্যারিসভিত্তিক জাতিসংঘ শিক্ষা, গণসংযোগ, সামাজিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেসকো) এককালীন প্রধান মবোয়া একসময় মন্তব্য করেছিলেন, পশ্চিমা দেশে গণমাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের অনলি ডেথ অ্যান্ড ডিজাস্টার মেক নিউজ।


মৃত্যু আর দুর্যোগই শুধু তাদের পত্রিকা আর টেলিভিশনে খবর হয়। এই কারণে তিনি ‘ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম’ তথা উন্নয়নমূলক সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করেছিলেন। মনে পড়ছে আমি যখন লন্ডনের সানডে টাইমস-এর জন্য কাজ করতাম, আমার সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্স একদিন টেলিফোনে জানতে চান মাস খানেক কোনো রিপোর্ট পাঠাচ্ছি না কেন। আমি জানালাম, ‘তেমন কিছু পাঠানোর নেই।’ এমন উত্তর দেওয়ার কারণ হচ্ছে, সবই যখন ভালোভাবে চলছে তখন তাই তো স্বাভাবিক, খবর দেওয়ার কিছু নেই, অর্থাৎ ‘অস্বাভাবিকতাই খবর’। টেলিফোনে হ্যারির মৃদু হাসির আওয়াজ শুনলাম, ‘গুড, নো নিউজ ইজ গুড নিউজ’। খবর না থাকাটাই অনেক সময়ে ভালো খবর। সময়টা যদি এখন হতো, ডেথ অ্যান্ড ডিজাস্টার এবং তা নিয়ে রাজনীতির অনেক ‘খবর’ পাঠিয়ে হ্যারিকে খুশি করতে পারতাম।
পত্রিকায় কোনো বিশেষ খবর না থাকা যে উদ্বেগের কারণ হতে পারে, এমনি উদাহরণ আমরা রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধানকালীন সরকারের সময়ে পেয়েছি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন বঙ্গভবনের সামনে সাংবাদিকদের বলতেন, ‘খবর নাই রে ভাই’ তখন জনগণ খুশি হতো না। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট তথা অচলাবস্থার অবসান নিয়ে জাতি উদ্বিগ্ন হতো। সাংবাদিক-উপদেষ্টা মাহবুবুল আলমের সুড়ঙ্গের মাথায় আলোর আভাসের খবরে খুশি হতো। যা-ই হোক, এখন প্রচুর ‘খবর আছে রে ভাই’ সংবাদপত্রের পাতায়। এখন পশ্চিমা মাধ্যম নয়, আমাদের গণমাধ্যমে ‘ডেথ অ্যান্ড ডিজাস্টারের’ মরণ আর অপঘাতের খবরে ভরপুর। সেই সব অনেক খবর সম্প্রতি পত্রিকায় প্রধান শিরোনাম হয়েছে। ‘থমথমে নাটোর’, কয়েক দিন আগে সব সংবাদপত্রে ছিল একটি মৃত্যুর খবর প্রধান শিরোনাম। কয়েক সপ্তাহ আগে আট কলামব্যাপী শিরোনাম ছিল, ‘বিক্ষুব্ধ পাবনা’। নাটোরে প্রথমে একজন বিএনপির নেতাকে পিটিয়ে হত্যা ছিল প্রধান খবর। সেই খবরগুলোর সংবাদপত্রের ভাষায়, ফলোআপ অর্থাৎ খবরের প্রতিক্রিয়া ও ক্রমবিকাশ ছিল পাঠকদের জন্য অধিকতর চমকপ্রদ। পাবনায় প্রশাসকদের কান্না, ক্ষমতাসীনের কারও পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ছুটে যাওয়া, অতঃপর প্রশাসনে গণবদলি। প্রথমে প্রকাশিত পাবনার শাসক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অঙ্গসংগঠনের কর্মী অথবা এবংবিধ পরিচয়ে পরিচিত ব্যক্তিদের সন্ত্রাসের খবরটি কদিন পরই আর গুরুত্বপূর্ণ খবর রইল না। সেটিকে ছাপিয়ে খবরের শীর্ষে এসেছে নাটোরে একটি হত্যা, প্রতিবাদে ‘স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল’, হরতালের পর কয়েক দিন বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির কতিপয় বিক্ষোভ সমাবেশ খবর হয়েছে। তারপর ট্রেন পোড়ানোর ছবি আর খবর। কয়েক দিন পরই এই খবরও প্রথম পাতার শীর্ষ থেকে নিচে নামতে থাকবে। একসময় সংবাদপত্রের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে। পাবনা আর নাটোরের পর সিরাজগঞ্জে অস্বাভাবিকভাবে ট্রেনের নিচে মৃত্যু আর সেই রেলগাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো রাজনীতির ময়দানের গরম খবর। জনগণেরও কেন জানি রাজনৈতিক খবরের প্রতি আগ্রহ বেশি। তাই তো ক্ষমতাসীন ও রাজনৈতিক দল খবর তৈরি করে চলেছে। অতিসম্প্রতি ভিন্ন ধরনের একটি খবর সব খবর ছাপিয়ে শীর্ষে উঠে এল। তুরাগে বাসডুবি হলো, কতজন যে লাশ হলো এই দুর্ঘটনায়, তার কোনো হিসাব আজও পাওয়া যায়নি। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, তুরাগের ঘটনার দায় সরকারের ওপর চাপানো হয়নি। সরকারের কোনো গাফিলতি নিয়ে বিরোধী দলের কেউ কোনো বিবৃতি দেয়নি। যাক্, এই মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি হয়নি!
প্রাসঙ্গিকভাবে একটি কথা বলা প্রয়োজন, দুর্ঘটনা, বাড়ি ধসে পড়া, রাজনৈতিক দলের হানাহানি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। এমনকি বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নতুন নামে ডাকা ‘বাজিকর’ কার্যকলাপও এখন তেমন খবর নয়। তবে তুরাগে বাস নদীবক্ষে তলিয়ে যাওয়ার দুর্ঘটনাটি শত শত সড়ক দুর্ঘটনা থেকে ভিন্ন ধরনের বলেই পত্রিকার পাতায় ‘বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে’। পাবনা আর নাটোর দুটি স্থানে খবরের উৎস দুর্ঘটনা নয়, ভিন্ন ধরনের কিন্তু একই চরিত্রের। দুঃখের বিষয় হলো, মৃত্যু আর দুর্ঘটনার ঘটনা যে ধরনেরই হোক জনমনে যখন যাতনা দেয় তখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মেতে ওঠে বিতর্কে। বক্তৃতা-বিবৃতিতে ‘ডালের মধ্যে কালা দানা’ আর ‘সরকারি মদদে ইচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগ’ স্বজনদের মাতম, সাধারণ মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা আর ক্ষোভের খবরকে পরিহাস করছে। এই পরিহাসের প্রকাশ ঘটেছে নাটোরের হত্যাকাণ্ড আর সিরাজগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের উচ্চপর্যায়ের বিতর্কে।
পাবনায় কতিপয় সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ‘প্রশাসনের’ কঠিন অবস্থান একটি ‘খবর’ হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। অতঃপর পুরো প্রশাসনই পাবনাছাড়া হলো। এ ঘটনায় সরকারি দলের লোকজনকে অবশ্য আটক করা হয়েছে, একটি মামলায় তাঁদের জামিন হলেও অন্য মামলায় এখনো জামিন মেলেনি। তেমন কিছু না হলে সর্বশেষে রয়েছে ‘ক্ষমা’। নাটোরে প্রশাসন অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিন্ত আছে, তাদের গণবদলি হবে না। কারণ নাটোরে তাদের কোনো গাফিলতি বা দায়িত্বহীনতার খবর পত্রিকার পাতায় আলোচিত হয়নি। শুধু পুলিশের ভূমিকা নিয়ে একটু-আধটু প্রশ্ন করা হয়েছে। সেখানে ঢাকা থেকে সরকারের উচ্চতম মহলের কেউ ছুটে যাননি। নাটোরের ঘটনায় নিশ্চুপ ও নির্বিকার থেকে স্থানীয় প্রশাসন সরকারের পরবর্তী যেকোনো পদক্ষেপ থেকে রেহাই পেলেও জনগণ একটি বার্তা পেয়েছে। নাটোরে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থেকেছে বলেই সরকারি দলের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে অথবা অভিযোগ করে রোষানলে পড়েননি। পাবনা জানিয়ে দিয়েছে এখন কোনো নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোবদ্ধ শাসনব্যবস্থা নেই। নাটোরের প্রশাসন জানান দিয়েছে, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নামকরণকৃত ‘বাজিকরদের’ খুশি রেখে, তাঁদের কোনো কর্মকাণ্ডে ‘হস্তক্ষেপ’ না করলেই স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে। কোনো ‘থমথমে’ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে বাধা দেওয়ার জন্য জবাবদিহি করতে হবে না। বান্দরবান বা খাগড়াছড়িতে বদলির আশঙ্কা থাকবে না, চাই কি পদোন্নতিতে বিবেচনায় আসবেন।
পাবনা আর নাটোরের ঘটনাবলি না হয় ‘সরকারি দলের’ চারিত্রিক পরিচয় বোঝা গেছে। দুটি স্থানের ঘটনাবলি গণমাধ্যমের ছবি আর ‘ফুটেজ’ দেখে জনগণ চমৎকৃত হয়েছে। পাবনা আর নাটোর নিয়ে সরকারকে তদন্তে ব্যস্ত রেখে আমরা তথাকথিত বিরোধী দল বিএনপির দিকে নজর দিই। দলের নামের আগে তথাকথিত শব্দটি ব্যবহার করার কারণ সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল বলতে সংসদে স্পিকারের বাঁ দিকের আসনে যাঁরা বসেন, তাঁদেরই বোঝায়। আমাদের দেশে রাজপথে যাঁরা মিছিল করেন, পুলিশকে ঢিল মারেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠির বাড়ি খেয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দেন, কাঁদানে গ্যাসে চোখের পানি ঝরান, তাঁদের বিরোধী দল হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। মোদ্দা কথা হচ্ছে, সরকার থাকে সংসদে আর বিরোধী দল থাকে রাস্তায় আর থাকে সংবাদ সম্মেলনে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিবৃতিতে। পালাবদল হলে এককালের সরকারি দল রাস্তায় যাবে, অন্যটি সংসদে যাওয়া-আসা করবে। মাঝে মাঝে অতি তৎপর হয়ে আচম্বিত মাঠে নেমে বাস পোড়ায় আর গাড়ি ভাঙে। এখন সেই পোড়াও-জ্বালাও তৎপরতা বৃহৎ মাত্রা পেয়েছে। বর্তমান সরকারবিরোধী কর্মীরা ছোটখাটো বাস বা গাড়ি পুড়িয়ে তৃপ্তি পান না। তাই এবার বড় আকারের রেলের গাড়ি পুড়িয়েছেন। গাড়ি পোড়ানো নিয়ে বিরোধী দলের কোনো আফসোস নেই, শুধু সরকারের গাফিলতির সূত্র খুঁজেছে। দলীয় নেত্রী নাটোরের চেয়ারম্যানের বাড়িতে তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েছেন। ট্রেনে কাটা পড়ে তাঁর জনসভা সার্থক করতে আসা কতজন দলীয় কর্মী মারা গেলেন, তাঁদের খোঁজ করেননি। কারণ তা পত্রিকার পাতায় বড় খবর হবে না, টেলিভিশনের ক্যামেরা তো সেখানে যাবে না। সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা করা যাবে না।
প্রতিবেদনের সূচনা করেছিলাম, ‘ডেথ আর ডিজাস্টার’ নিয়ে। নাটোরে ‘ডেথ’ আর সিরাজগঞ্জে ‘ডিজাস্টার ও ডেথ’ দুটোই ঘটেছে। শুধু মৃত্যু আর দুর্যোগ বলে আমি ক্ষান্ত হলেও সাম্প্রতিককালে আরও অনেক ‘শব্দ’ যোগ হয়েছে সংবাদপত্রের পাতায়। বুধবারের প্রথম আলোতে ফারুক ওয়াসিফ বোধহয় অভিধান থেকে এসব শব্দ সংগ্রহ করে বর্তমান সময়ের দেশের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তাঁর শব্দ চয়নের প্রশংসা করছি। কী সে শব্দগুলো যা দেশের বিদ্যমান রাজনীতি ও জনজীবনের ছবি তুলে ধরেছে? ওয়াসিফের ‘অপঘাত, নিষ্ঠুরতা, দায়িত্বহীনতা আর হাহাকার’-এর সঙ্গে আব্দুল কাইয়ুমের কলামটির শিরোনামে এসেছে ‘সহিংসতা’। এই শব্দাবলি জনগণের মনে যেমন হতাশা ও দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলেছে তেমনি আমাদের মতো কলাম লেখকদের লেখার খোরাক জোগাচ্ছে। টিভির ক্যামেরাম্যান বার্তাকক্ষে ফুটেজ জমা দিতে পারছেন। সংবাদপত্রের রিপোর্টার আর বার্তা সম্পাদক পাতা ভরানোর রসদ পাচ্ছেন। সরকারবিরোধী রাজনীতিবিদেরাও ‘জোর আন্দোলন’ গড়ে তোলার হুংকার দিতে পারছেন।
‘জার্নালিস্টস লিভ অন আদার পিপলস ডেথ’, মানে অন্যেরা মরছে বলেই সাংবাদিকদের জন্য খবর তৈরি হচ্ছে। সংবাদপত্র জগতে কথাটি অনেক দিন ধরে চালু আছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে আমাদের ‘পলিটিশিয়ানস পলিটিসাইজ আদার পিপলস ডেথ’। ক্ষমতাধারী, ক্ষমতাহারা এবং ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদেরাও মানুষের দুঃখ, বেদনা, দুর্ভোগ আর মৃত্যুকে পুঁজি করে রাজনীতি করেন। মনে হয়, ‘দেয়ার পলিটিকস ডিপেন্ড অন পিপলস ডেথ অ্যান্ড সাফারিংস’। নিবন্ধকার ওয়াসিফ উল্লিখিত অপঘাত, নিষ্ঠুরতা, দায়িত্বহীনতা ও জনগণের হাহাকারই ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতালিপ্সুদের রাজনীতির পুঁজি। কবে যেন বিপ্লবী কবি সুকান্ত লিখেছিলেন, ‘অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার/ দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার’। সুকান্ত বেঁচে থাকলে প্রশ্ন করতেন, ‘অবাক যে বারবার, মৃত্যুর রাজনীতিতে জনগণ কেন নির্বিকার।’
 এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.