লিবিয়া-মিত্র’ বাহিনীর বোমায় শহীদদের কথা by রবার্ট ফিস্ক

অতীতের জীবন কেমন করে যেন বর্তমান জীবনের নাগাল পেয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের ১৫ এপ্রিল রাত দুইটার পর পর রাফাত আল-ঘোসাইনকে হত্যা করেছিল মার্কিনরা। তাঁর মৃত্যুর পরের কয়েক দিন মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছিলেন, তাঁর বাড়িতে যুদ্ধবিমানরোধী লিবীয় হামলা আঘাত হেনে থাকতে পারে।


সে বাড়িটি ত্রিপোলির উপশহরে ফরাসি দূতাবাসের বেশ কাছে। সামনের দিনগুলোতে মার্কিনদের একই ধরনের দাবির দিকে নজর রাখুন।
রাফাতের মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পর মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন স্বীকার করল, কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মার্কিন হামলার অংশ হিসেবে (বার্লিনের এক নাইট ক্লাবে লিবীয় এজেন্টের হামলার প্রত্যাঘাত এই হামলা) এফ-১১১ যুদ্ধবিমান থেকে তিনটি বোমা ফেলা হয়েছিল, যেগুলো পড়েছিল ‘ফরাসি দূতাবাসের কাছে’। ফলে ‘কোলাটেরাল ড্যামেজ’ (বাড়তি লোকসান) হয়েছে।
তখন ঘোসাইনের বয়স ১৮ বছর। লন্ডনের এক ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা করতেন, ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। প্রতিশ্রুতিশীল ও সুন্দর শিল্পী। সিকি শতাব্দী আগে সেই ব্যক্তিগত মৃত্যু তাঁর হত্যাকারী রাষ্ট্রের রেকর্ডে ঢুকতে পারেনি। তাঁর মা লেবাননি আর বাবা ফিলিস্তিনি। বাবা তখন লিবীয় তেল কোম্পানিতে কর্মরত। রাফাত আজ বিস্মৃত।
আমরা (পশ্চিমারা) বরাবরের মতো নিজেদের প্রয়াত মানুষদেরই স্মরণ করি। অন্যদের না, সে তা লিবীয় কিংবা লেবাননি, আফগান কিংবা সিরীয় যে-ই হোক না কেন। শুধু নীল চোখের ধবল মানুষেরাই গোনার মধ্যে থাকে। বাকি সব ‘বাড়তি লোকসান’। গতকাল সকালে ঘোসাইনের কথা মনে পড়ে গেল যখন ‘মিত্র’ বাহিনী (টেলিভিশনের কলরবে অচিরে হাজির এই শব্দ) লিবিয়ার বিরুদ্ধে তাদের ‘বিমানবাহিনীর সম্পদ’ নিয়ে, গাদ্দাফির বিরুদ্ধে ‘স্থল’ অভিযান শুরু করল। ১৯৮৬ হামলার সময় ছিলেন রোনাল্ড রিগান। এখন বারাক ওবামা। মনে হচ্ছে, আগেকার চেয়ে এবার ভাগ্য প্রসন্ন।
২৫ বছর আগে শহীদ বেসামরিক ব্যক্তিদের শেষকৃত্যে কর্নেল গাদ্দাফির লোকেরা গণমাধ্যমকে সমাধিস্থলের সামনে ডেকে নিয়ে যায়। মার্কিন জিঘাংসু হামলা আমরা সশরীরে হাজির থেকে রেকর্ড করেছিলাম। দেখলাম, একটি কফিনে লেবালনি (সাদা ও লাল জমিনের ওপর সিডার গাছ) ও ফিলিস্তিনি পতাকা। লেবাননে আমি আগেও থেকেছি, এখনো থাকি। সেই মেয়েটির হতবিহ্বল, শোকাহত মা সানিয়াকে খুঁজে বের করলাম ভিড় ঠেলে। আমাকে তিনি বললেন, ‘আমরা মুসলমান, কিন্তু আমাদের বিধাতা তো এক। আমরা এক জাত। আশা করি, রিগান সাহেব সেটা বোঝেন।’
ঘোসাইনের বাবা বাশাম বহু বছর ধরে প্রতিকার চেয়েছেন। চোখের সামনে দেখেছেন আরেক মেয়ে কিনদার যন্ত্রণা। অন্তত বৈরুতে কিনদার পড়াশোনার খরচ দিতে বলেছেন তিনি মার্কিন কর্তৃপক্ষকে; যেহেতু তাঁর বোনকে হত্যা করেছে আমেরিকা। মারা যাওয়ার সময় ঘোসাইন নিজ বাড়িতে টেলিভিশন কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন। বাড়িটি ফরাসি দূতাবাসের কাছে। তখন দুই হাজার পাউন্ড ভারী বোমা পড়ল, গুঁড়িয়ে গেল প্রতিবেশীদের বাড়িঘর। যে পাঁচজন ছিলেন তাঁদের সবাই নিহত হলেন।
লিবীয় নিরাপত্তাকর্মীদের একটি দল যখন মেয়েটির শরীরের ওপর থেকে দেয়াল সরিয়ে নিল, তখন তাঁর বাবা যা দেখেছিলেন তা রেকর্ড করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘চিত হয়ে শুয়ে ছিল আমার মেয়ে। ডান দিকে মাথা সামান্য কাত করা। অক্ষত দেহ, বিন্যস্ত চুল আর মাথার উপরিভাগ থেকে বেরোতে থাকা রক্তের দাগ বাঁ কপাল বেয়ে নেমে যাচ্ছিল।’
সে সময় বার্লিন নাইট ক্লাবে এক মার্কিন সেনার মৃত্যুর ফলে এই আক্রমণ করা হয়েছিল। রোববারের হামলার কারণ, কর্নেল গাদ্দাফি যেন ঘোসাইনের মতো বেসামরিক মানুষদের না মারতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে পাস হওয়া জাতিসংঘের প্রস্তাব।
বৈরুতে বিগত বছরগুলোতে ঘোসাইন-পরিবারকে ঘনিষ্ঠভাবে আমি দেখেছি। তাদের নিয়ে লিখেছি, একসঙ্গে খাবার খেয়েছি, তাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। এখনো তাদের বাড়িতে টাঙানো রয়েছে তাদের মেয়ের আশ্চর্য চিত্রকর্ম। কিনদা বিয়ে করেছেন। গতকাল অনেক উত্তেজনা নিয়ে ফোন করেছিলাম পরিবারটিকে। ফোন ধরলেন ঘোসাইনের মা। তিনি বললেন, ‘আশা করি, এবার তাঁকে বাগে আনবে তারা।’ চকিতে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি গোঁফওয়ালা লোকটাকে বোঝাচ্ছেন কি না। কর্নেল গাদ্দাফির গোঁফ আছে। ওবামা সাহেবের নেই। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ঘাজ্জেফিকেই বোঝাচ্ছি।’ লেবাননি আরবি উচ্চারণে লোকটার নাম ‘ঘাজ্জেফি’।
ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.