পরিবেশ-পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রতিবেশ রাজনৈতিক পাঠ by পাভেল পার্থ

আর কিছু না হোক, সংবিধান সংশোধনী কমিটির সম্মানিত সাংসদরা যদি নিজের এলাকায়ও সংবিধানের এ ধারাটির প্রতিবেশ-রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করার উদ্যোগ নেন, তাহলে টের পাবেন প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশমুখী নিম্নবর্গ কেন সংবিধানবিমুখী


জানি, সংবিধান দিয়ে দেশের নিম্নবর্গের কিছু যায়-আসে না। তা না হলে দেশের নৃতাত্তি্বক সংখ্যাগুরু, বৃহৎ নৃগোষ্ঠী, বৃহৎ জাতিসত্তা বাঙালি জাতি এত বছর পর তাদের জাতিগত আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি পেয়েও কোনো ধরনের আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠেনি। হয়তো এ সংশোধনীর পরই দীর্ঘসময় অতিক্রম করে 'বাঙালি জাতি' রাষ্ট্রীয় নথি-দলিলে তার জাতিগত পরিচয়টি লিখতে পারবে। আত্মপরিচয়ের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে মুখরিতহীন একটা দেশের জনগণের জীবনে সংবিধান কী ধরনের প্রভাব ফেলে, তা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের দরকার হয় না। এ ক্ষেত্রে সংবিধানে দেশের আদিবাসী জনগণের আত্মপরিচয়ের অস্বীকৃতির প্রসঙ্গ চলতি আলাপে টানছি না। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীকে প্রতিবেশীয় রাজনৈতিক পাটাতন থেকে পাঠ করতে চাইছে চলতি আলাপ। এখনও পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনীর এ জায়গাটি নিয়ে কোনো বাহাস বা আলাপ উত্থাপিত হয়নি। সে ক্ষেত্রে এটাও বোঝা যায়, মনস্তাত্তি্বকভাবে আমরা কতটা প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ও ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো সংবিধান সংশোধনী হয়েছে, যেখানে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য প্রসঙ্গকে রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে স্বীকার করেছে। নবম জাতীয় সংসদের ২০১০ সালের ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার প্রস্তাবক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংসদদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২৬৬ বিধি মোতাবেক ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি 'বিশেষ কমিটি' গঠন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত ওই বিশেষ কমিটি মোট ২৭টি বৈঠকে মিলিত হয়ে ৫১ দফা সুপারিশবিশিষ্ট একটি সংবিধান সংশোধনী প্রতিবেদন তৈরি করে। ২০১১ সালের ৮ জুন এ প্রতিবেদন নবম জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। ওই সংশোধনী প্রতিবেদনে ১৩ নম্বর দফা হিসেবে 'পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ' শিরোনামে একটি সুপারিশ করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮-এর পর 'পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের' ওই নতুন অনুচ্ছেদ ১৮ক হিসেবে সনি্নবেশ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশে বলা হয়, 'রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর নিরাপত্তা বিধান করিবেন।' অতি নির্বিবাদ ও নির্ঝঞ্ঝাটে নবম জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধানে ওই সুপারিশটি গৃহীত হয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে কেউ কোনো মানববন্ধন, হরতাল, বয়কট, সংশোধনী, অনশন বা বিক্ষোভের ঘোষণা দেননি। পাশাপাশি এর সপক্ষেও কেউ কোনো আনন্দ-আয়োজন, উল্লাস ও ধন্যবাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, দেশের নিম্নবর্গের যেমন আছে সংবিধান-বিমুখীনতা, পাশাপাশি নিম্নবর্গের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের প্রতিও রয়েছে চরম অনীহা ও বিচ্ছিন্নতা। আমরা জানি, এই একটি অনুচ্ছেদকে পাশ কাটিয়ে অন্য অনুচ্ছেদগুলো থাকল কি থাকল না, তা নিয়ে বিতণ্ডা ও যুদ্ধ কেবল চলতেই থাকবে প্রবল সংবিধানমুখী রাষ্ট্র নেতৃত্বের ভেতরেই, যার সঙ্গে নিম্নবর্গ জনগণের সম্পর্ক নেই।
সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত ১৫ সদস্যবিশিষ্ট 'বিশেষ কমিটি'তে দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশনির্ভর জনগণের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ওই কমিটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তরাঞ্চল, বৃহত্তর সিলেট, সুন্দরবন অঞ্চল, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল মানে দেশের প্রাকৃতিক বনভূমি অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধির প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ওই কমিটি দেশের ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল, প্রাকৃতিক বনভূমি অঞ্চল, সব প্রাণ-প্রতিবেশ অঞ্চল, ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলসহ দেশের পাহাড়, চর, বন, টিলাভূমি, বরেন্দ্র, গড়, দ্বীপ ও বৈচিত্র্যময় সমতলের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য এবং বিরাজমানতাকে বিবেচনায় এনেই 'পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ' ধারাটি যুক্ত করেছে। আমরা এখন অভূতপূর্ব এ ধারাটি নিয়ে প্রতিবেশ-রাজনৈতিক পরিসরে কিছুটা আলাপ তুলব।
বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা বিধান করিবেন।' এখন প্রশ্ন অনেক। রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিক বলতে কাদের বোঝাতে চায়? পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রাণবৈচিত্র্য (জানি না বারবার উল্লেখের পরও কেন যে জীববৈচিত্র্য প্রত্যয়টিই ব্যবহার করা হয়), জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীরির্ভর জনগণের, না যাদের সঙ্গে এসবের কোনো ঐতিহাসিক নির্ভরশীলতা নেই সেই জনগণের। কারণ দু'জনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও দায় দু'রকমের হবে। পরবর্তী প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র এ পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা কেন করতে চায়, কিসের জন্য সে বিষয়ে রাষ্ট্রের ব্যাখ্যাগুলো জনগণের কাছে স্পষ্ট করা জরুরি। পরের প্রশ্ন, রাষ্ট্র এ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা কী প্রক্রিয়ায় এবং কীভাবে করবে বা করতে চায়? আপাতত শেষ প্রশ্ন হলো_ পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী বলতে রাষ্ট্রের সংবিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কী? কারণ এতে জড়িয়ে আছে মালিকানা ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রশ্ন। আমরা প্রথমেই ভেবে নিচ্ছি, রাষ্ট্র অনেক ভেবেচিন্তে সব নথি-নকশা করে উপরোক্ত ধারাটি সংবিধানে সনি্নবেশ করেছে। আর আমাদের ধারণা যদি সঠিক না হয়, শুধু একটি ধারা রাখার জন্য যদি শুধু এটি করা হয়, লোক দেখানো 'পরিবেশবাদিতা' উস্কানোর জন্য যদি এটি করা হয়, তবে এ ধরনের ধারা রাখার মাধ্যমেও দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের সঙ্গে অন্যায় করা হয়। দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের ওপর সব জুলুম ও অত্যাচার স্বীকার করেই এ অবিচার বন্ধ করতে রাষ্ট্র এ সাংবিধানিক উদ্যোগটি নিয়েছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীকে সঙ্গে নিয়ে এবার একটু দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের রক্তাক্ত শরীর এবং সীমানা সংক্ষেপে ঘুরে আসা যাক। দেশের দুটি রামসার অঞ্চল সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবন দিয়ে শুরু করি আসুন। উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে উপর্যুপরি করপোরেট কয়লা, পাথর ও ইউরেনিয়াম খনির ফলে টাঙ্গুয়ার হাওর ক্রমান্বয়ে এক প্রত্নতাত্তি্বক জলাভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। পাশাপাশি সংরক্ষণের নামে নানা উন্নয়ন প্রকল্প কর্মসূচি হাওরনির্ভর জনগণের প্রথাগত ভাসান পানির অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। পৃথিবীর একক আয়তনে সবচেয়ে বড় জোয়ার-ভাটার বনভূমি সুন্দরবনে শেল কোম্পানিকে খননের অনুমতি দিয়েছিল রাষ্ট্র। সম্প্রতি সুন্দরবনের কোলে নির্মিত হতে যাচ্ছে ২৬৪০ মেগাওয়াটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বন বিভাগকে সক্রিয় ও সুগঠিত না করে সুন্দরবনের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএসআইডির নিসর্গ নেটওয়ার্ক কর্মসূচির হাতে। এবার আসি দেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাকৃতিক বনভূমি এলাকার জাতীয় উদ্যানগুলোতে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বারবার ছিন্নভিন্ন হয়েছে করপোরেট অক্সিডেন্টাল, ইউনোকল ও শেভরনের বিচার-বিবেচনাহীন খননের কারণে। মধুপুর জাতীয় উদ্যান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আগ্রাসী বনায়ন ও রাবার প্রকল্প, তথাকথিত সামাজিক বনায়ন এবং ইকোপার্কের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়ে এক ক্ষয়িষ্ণু অংশ নিয়ে টিকে আছে। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ও ভাওয়ালগড়ের শালবনভূমির আজ পুরোটাই দখল ও হত্যা করেছেন প্রভাবশালী মিল-কারখানার মালিকরা। আমরা সবাই জানি, তারা কোনো না কোনোভাবে সংবিধানমুখী জনপ্রতিনিধি বা তাদের আত্মীয়-স্বজন। ভাওয়ালগড়ের রাথুরা শালবন হত্যা করার জন্য আবার এক সাফারি পার্কের উন্নয়ন কর্মসূচি চলছে। এবার আসা যাক দেশের নদী, জলাভূমি ও জলধারাগুলোর করুণ গলিত রুদ্ধ লাশের স্তূপে। চলতি আলাপে আমি দেশের নদ-নদীগুলোর রক্তাক্ত পরিণতির কথা টানছি না। দেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল হত্যা করে মহাসড়ক বানানো হয়েছে, চান্দারবিল, বাঁওড়, পাহাড়ি ছড়া, ঝরনাগুলো পর্যন্ত আজ উন্নয়নের কাছে জিম্মি। চিন্তা করা যায়, দেশের সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত মাধবকুণ্ডকে ইজারা দিয়ে বিক্রি করা হয়। চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়গুলোর কী করুণ পরিণতি, তা অন্তত বর্ষাকালে পাহাড়ধসের মাধ্যমেও টের পাওয়া যায়। দেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসম্পদ পর্যন্ত আজ কনোকো-ফিলিপসের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে সরকার। দেশি ধানসহ কৃষি ও জুম প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের, নেই দেশীয় ও স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার কোনো রাজনৈতিক দায় ও দায়িত্ববোধ। জনগণের কোনো অনুমতি ও সুপারিশ ছাড়াই চূড়ান্ত করা হয়েছে 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন, ২০১০'। তার পরও রাষ্ট্রকে আদিগন্ত ধন্যবাদ, সংবিধানে দেশের মুমূর্ষু প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশের নিরাপত্তা বিধান করতে তারা অঙ্গীকার করেছে। আর কিছু না হোক, সংবিধান সংশোধনী কমিটির সম্মানিত সাংসদরা যদি নিজের এলাকায়ও সংবিধানের এ ধারাটির প্রতিবেশ-রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করার উদ্যোগ নেন, তাহলে টের পাবেন প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশমুখী নিম্নবর্গ কেন সংবিধানবিমুখী।

পাভেল পার্থ : গবেষক
animistbangla@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.