রমনায় বোমা হামলার ১১ বছর

হত্যাকারীদের বিচার দ্রুত সম্পাদন করা হোক 'জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনায়েড'- এক অতি পুরনো সত্য। অর্থাৎ বিচারকাজ যত বিলম্বিত হবে, ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা তত কমে যাবে এবং কার্যত অস্বীকৃত হবে রমনার বটমূলে ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখ ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন অনেকে।


এর পর ১১টি বছর কেটে গেছে। জঘন্য হামলাকারীদের শাস্তি হয়নি। এই ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলার কোনোটিরই রায় হয়নি এ পর্যন্ত। কবে নাগাদ রায় পাওয়া যেতে পারে, তাও বলা যাচ্ছে না। তাহলে কি 'ডিলেইড জাস্টিস'-এর কারণে এমন একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আসামিরাও পার পেয়ে যাবে? এমন জঘন্য খুনিদের বিচারও 'ডিনায়েড' হয়ে যাবে? তাহলে এই দেশ, এই সমাজের ন্যায়বিচারের ওপর মানুষ আস্থা রাখবে কিভাবে?
এই ঘটনার পর এ পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেছে মোট চারটি সরকার। ২০০১ সালে ঘটনার সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তার কয়েক মাস পর ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার। বিচার হয়নি। এর পর আসে দুই বছরমেয়াদি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাদের শেষ সময়ে ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর একই সঙ্গে দুটি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায় মামলা দুটি এবং ১৬ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল-৩-এ এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল-১-এ পাঠানো হয়। একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রাইবুন্যাল-১-এর বিচারক মামলা দুটির আসামি, সাক্ষী ও আলামত অভিন্ন হওয়ায় মামলা দুটি একই আদালতে বিচারের পক্ষে মতামত দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে একটি আবেদন পাঠান। তিন বছরেও সেই আবেদনের বিপরীতে কোনো সিদ্ধান্ত আদালতের কাছে পৌঁছেনি। ফলে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে। অন্যদিকে দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল আইন অনুযায়ী ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ সম্পন্ন না হলে মামলা দায়রা আদালতে ফেরত যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সেখানে ছয় মাস পরপরও সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য হয়েছে। আবার জঙ্গি বলে পরিচিত এসব আসামি আরো অনেক মামলার আসামি হওয়ায় তাদের দেশের অন্যান্য আদালতে পাঠানোর ফলে নির্ধারিত সাক্ষ্যগ্রহণের দিন আসামির অনুপস্থিতির কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ করা যায়নি- এমন ঘটনাও ঘটেছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মামলায় এ ধরনের কালক্ষেপণের ঘটনা জাতিকে কেবল হতাশই করেছে। একই ভাবে জাতি হতাশ হয়েছে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা, পল্টনে সিপিবির জনসভায় বোমা হামলা, ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার ঘটনাসহ আরো বেশ কিছু স্পর্শকাতর হত্যা মামলায় তদন্তের ব্যর্থতা ও বিচারের বিলম্ব দেখে। তদন্তের ব্যর্থতা কিংবা জজ মিয়া কাহিনী সাজিয়ে তদন্তকে প্রভাবিত করার বহু অপচেষ্টাও আমরা অতীতে দেখেছি। বর্তমান মহাজোট সরকারের সময় আমরা অন্তত স্পর্শকাতর মামলাগুলোয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা আশা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সে আশা অনেকাংশেই হোঁচট খেয়েছে। তার পরও আমরা আশা করি, রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলা দুটির বিচারকাজ দ্রুততর করার ব্যাপারে সরকার তাদের সর্বোচ্চ তৎপরতা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করবে।

No comments

Powered by Blogger.