কমিউনিটি রেডিও-‘চান্দেরি কি আওয়াজ’ by শান্ত নূরুননবী

কমিউনিটি রেডিও হলো থার্ড রেডিও। একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের অধিবাসী নিজেদের আগ্রহ ও প্রয়োজনের বিষয়গুলো নিজেদের পরিচালিত কমিউনিটি রেডিওতে প্রচার করতে পারে, যা জাতীয় বেতার বা কোনো বাণিজ্যিক প্রচারমাধ্যমে সম্ভব হয় না।


কমিউনিটির প্রত্যেক ব্যক্তির পারস্পরিক ও গণযোগাযোগের কার্যকর মাধ্যমও বটে এই রেডিও। সর্বসাধারণের ঐতিহ্যপ্রসূত জ্ঞান ও স্বপ্ন বিনিময়ের মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের সমৃদ্ধতর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করতে পারার সম্ভাবনা ধারণ করে কমিউনিটি রেডিও। প্রয়োজন কেবল এর শক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা।
১৯৭০ সালের দিকে আয়ারল্যান্ডে প্রথম কমিউনিটি রেডিওর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন এই থার্ড রেডিও প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। বর্তমান সরকার গত বছরের এপ্রিলের শুরুর দিকে ১৪টি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে কমিউনিটি রেডিও স্টেশন স্থাপনের লাইসেন্স দেয়। তারও আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও কার্যক্রম নীতিমালা, ২০০৮ প্রণয়ন করে। এর পরের বছরই অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে ও তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পাস হয় তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯। কমিউনিটি রেডিও হবে স্বল্প ব্যয়ে সর্বসাধারণের কাছে তথ্য পৌঁছানোর সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। গ্রামীণ জনগণের ক্ষমতায়ন ও বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের অনুমোদন একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। দেরিতে হলেও বিটিআরসি গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কয়েকটি সংস্থাকে কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচারের ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ দিয়েছে। এখন ডিমান্ড নোট জমা দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হলেই সম্প্রচার লাইসেন্স দ্রুতই দেওয়া হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অর্থাৎ, শিগগিরই বাংলাদেশ কমিউনিটি রেডিওর যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ভারতবর্ষের কয়েকটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশন পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ‘চান্দেরি কি আওয়াজ’ পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরব।
মধ্যপ্রদেশের পাথুরে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ঘনবসতিপূর্ণ শহর চান্দেরি। সম্রাট বাবরের দুর্গ-চূড়া থেকে পুরো শহরটাই দেখে নেওয়া যায় একনজরে। ঘিঞ্জি এই শহরের শেষ প্রান্ত ছুঁয়ে ‘বুনকার’, অর্থাৎ তাঁতি সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মুসলমান তাঁতির ভাষা উর্দু হলেও প্রধান ভাষা বুন্দেলি, প্রায় হিন্দির মতোই, হিন্দির উপভাষাই বলা যেতে পারে। এখানকার তাঁতে বোনা ‘চান্দেরি শাড়ি’ বিখ্যাত। রাজধানী দিল্লি বা ভারতের বড় শহরগুলোতে চড়া দামে চান্দেরি শাড়ি বিকোলেও বুনকারদের গড় আয় দিনে ১০০ রুপির বেশি ছিল না তিন বছর আগেও। দারিদ্র্য আর শিশুদের শিক্ষাবঞ্চনা যেন মেনেই নিয়েছিলেন এই সহজ-সরল বয়নশিল্পীরা। ২০০৮ সালের শুরুতে বুনকারীদের সমবায় সংগঠন ‘বুনকার বিকাশ সংস্থা’র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ান ওয়ার্ল্ডের নয়াদিল্লি কার্যালয় এই অতি দূর মফস্বলে আয়োজন করে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কর্মশালার। ওয়ান ওয়ার্ল্ড যেহেতু কমিউনিটি রেডিও নিয়েও কাজ করে, তারা বুনকারদের নিজেদের একটা রেডিও স্টেশন করার পরামর্শও দেয় উপযাচক হয়ে। বুনকার সম্প্রদায়ের জনা কয়েক স্বপ্নবান তরুণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রেডিও অনুষ্ঠান তৈরি ও সহজ সফটওয়্যার ব্যবহারের ওপর একটি বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নেন। তাঁদেরই কয়েকজন—রাজ, শাবানা, সীমা, ইয়াসিন, পূজা, নাজির আখতার প্রমুখ কোমর বেঁধে মাঠে নামলেন ট্রান্সমিটার, অ্যান্টেনা, কম্পিউটার ইত্যাদি কেনার টাকা জোগাড় করতে। ভারতের ট্রান্সমিটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েবেল’ তরুণ বুনকারদের উৎসাহ ও দৃঢ়তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিস্তি মূল্যে ট্রান্সমিটার, কনসোল সরবরাহ করে। বুনকার বিকাশ সংস্থা স্থানীয় রেডিও স্টেশনটি স্থাপন করে। বুনকারীরা আবিষ্কার করলেন, তাঁদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া কোনো মেয়ের মধ্যেই আছে লতা মুঙ্গেশকরের প্রতিভা। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর যে পূজা দারিদ্র্যের ধাক্কায় স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিল, সে এখন বয়স্ক মানুষের বলা গল্প রেকর্ড করে রেডিওতে প্রচার করে। নিজেই স্ক্রিপ্ট লেখে, নিজেই এডিট করে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর মতো নিখুঁত হয় না পূজার অনুষ্ঠান। কিন্তু শ্রোতাদের কাছে অল ইন্ডিয়ার অনুষ্ঠান নয়, চান্দেরি কি আওয়াজে ঘরের মেয়ে পূজার কণ্ঠে বুন্দেলি ভাষায় নিজেদের গল্পের অনুষ্ঠানই বেশি প্রিয়। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে নাজির আখতারের আওয়াজের অনুপ্রেরণায়। কেউ এখানে চাকরি করে না, বেতন পায় না। সবাই মিলে একটি রেডিও করে।
আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি, তাদের ওরা উপদেশ দেয়, ‘নিজেদের সাধ্যের মধ্যেই কমিউনিটি রেডিও শুরু করো। কিন্তু যাদের জন্য করছ, তারা যেন উপলব্ধি করে যে এটা তাদের নিজেদের রেডিও। কমিউনিটি রেডিওর মালিক কমিউনিটির সবাই।’
আমাদের দেশে একটি ছাড়া সব কটি কমিউনিটি রেডিওর উদ্যোক্তা কোনো না কোনো এনজিও। এই কমিউনিটি রেডিওগুলো সত্যিকার অর্থে জনগণের উন্নয়নমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা তাদেরই দায়িত্ব।
গত বছর কমিউনিটি রেডিও স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়ার সঙ্গে একটি শর্ত দেওয়া হয়, অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক বছরের মধ্যেই সম্প্রচারে যেতে হবে। বেশির ভাগ সংস্থাই নীতিগত কারণে ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ পাওয়ার আগ পর্যন্ত, বিশেষ করে ট্রান্সমিটার ও অ্যান্টেনা কেনার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেনি। এই যন্ত্রগুলো কেনার জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়ার পর সেগুলোর সরবরাহ ও স্থাপনে কমপক্ষে দেড় মাস সময় প্রয়োজন হবে। আমরা আশা করি, সরকার কমিউনিটি রেডিওগুলোকে সম্প্রচারে যাওয়ার সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়ে জনগণের কৃতজ্ঞভাজন হবে।
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.