প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফর-বোঝাপড়া থেকে সক্রিয় সহযোগিতা

তুরস্কে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফর বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতারই সাম্প্রতিকতম স্মারক বিবেচিত হবে। আমাদের মনে আছে, দেশটির পক্ষ থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল এবং নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগান ঢাকা সফরে এসেছিলেন।


বাংলাদেশের প্রতি তুরস্কের এই আগ্রহ নিঃসন্দেহে বিশেষ গুরুত্ববহ। আমরা জানি, ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের এই কেন্দ্রভূমি প্রাচীনকাল থেকেই ভূকৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকেও আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে ন্যাটোর একমাত্র সদস্য আঙ্কারার স্বাতন্ত্র্য ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্কও বিশেষত্বের দাবি রাখে। সাংস্কৃতিক সম্পর্কের বাইরেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মের স্থান নিয়ে দেশ দুটির অবস্থান নিকটতম। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আঙ্কারার অভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের মানুষের মনে চির ভাস্বর হয়ে আছে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসবে যোগ দেওয়া মুসলিম বিশ্বের দু'জন নেতার অন্যতম ছিলেন তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল। বেশিরভাগ মুসলিম দেশ একনায়ক ও রাজতন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা থাকলেও এই দুই দেশের সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিই দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে এসেছে। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও তুরস্কের সম্পর্ক যে আরও অর্থপূর্ণ হতে যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতাগুলো তার প্রমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও আঙ্কারার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগে উৎসাহব্যঞ্জক অগ্রগতি দেখা গেছে। এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তা আরও সংহত হবে বলে আমরা আশা করি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুর্কি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় শতাধিক ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী তার সঙ্গী হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট গুল ওই সময় বারবারই জোর দিয়েছেন দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের প্রতি। আমাদের দেশে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও উদ্যোক্তারাও এবার প্রধানমন্ত্রীর তুরস্ক সফরসঙ্গী হয়েছেন। আমরা জানি, বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে বর্তমানে কমবেশি ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়ে থাকে। দুই পক্ষ আন্তরিক হলে এটাকে আরও বাড়ানো সম্ভব। আমরা আশা করি, সরকারের পাশাপাশি দুই দেশের ব্যবসায়ীরাও সামনের দিনগুলোতে তৎপর থাকবেন। বিজ্ঞান ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিময় কর্মসূচি বিষয়ে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকটিকেও আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই। তুর্কি প্রেসিডেন্টের সফরের সময় দুই দেশ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর ব্যাপারে যে ঐকমত্য পোষণ করেছিল, এই স্মারক তারই পরবর্তী ধাপ। ২০১০ সালের নভেম্বরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকা-ইস্তাম্বুলে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী তুর্কি এয়ারলাইন্সের সরাসরি ফ্লাইট চালুর প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছিল। এ বছর মার্চে তা চালু হয়েছে। শেখ হাসিনার সফরের সময় স্বাক্ষরিত কূটনীতিক ভিসা পরিহার সংক্রান্ত চুক্তিও দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এও আর আকাশ-কুসুম নয় যে, দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভিসামুক্ত যাতায়াত চালু হবে। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির (রহ.) স্মৃতিধন্য কোনিয়া এবং হজরত শাহজালালের (রহ.) পুণ্যভূমি সিলেট শহরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রটোকলটিও দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। আমরা জানি, তুরস্ক-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সময়ের কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত। আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় ভ্রাতৃপ্রতিম দেশটির সহযোগিতা নিয়ে কোনোই সন্দেহ থাকা উচিত নয়। এখন প্রয়োজন কেবল পারস্পরিক বোঝাপড়াকে আরও কার্যকর করে তোলা।

No comments

Powered by Blogger.