শিক্ষাঙ্গন-বিশ্ববিদ্যালয় ও ‘রক্তাক্ত’ শিক্ষার অধিকার by মো. জাকির হোসেন

মোল্লা নাসির উদ্দিন একবার গলির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। গলির পাশের বাসার ছাদ থেকে এক লোক পা ফসকে মোল্লার ঘাড়ের ওপর পড়ে যায়। এতে মোল্লার ঘাড় ভেঙে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসার পর মোল্লা সাহেব সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁর শিষ্যরা জানতে চান, এ ঘটনা থেকে কী শিক্ষা গ্রহণ করা যায়? মোল্লা সাহেব জবাব দেন—তত্ত্বের কথা


হলো, যে ছাদ থেকে পড়ল তার ঘাড় ভাঙবে, বাস্তবে ভেঙেছে আমার। কাজেই তত্ত্ব সব সময় সত্য নয়। মোল্লার বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত শিক্ষা দর্শনের গভীর অনুরাগী আমি টেকসই গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শিক্ষার অধিকারের ভূমিকা বিষয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা নিয়ে সবেমাত্র ক্লাসে আলোচনা শুরু করেছি। এমন সময় এক ছাত্র দাঁড়িয়ে ১৮ মার্চের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হয়, সাজা হয় না’ শিরোনামের একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শরিফুল হাসানের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত ৪০ বছরে দেশের চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২৯ জন ছাত্র হত্যার শিকার হয়েছেন। ১২৯টি হত্যাকাণ্ডের প্রতিটিতে যদি মাত্র একজন করে ঘাতকও থাকে, তাহলে ঘাতকের সংখ্যা ন্যূনতম ১২৯ জন বলে ছাত্রছাত্রীরা মত দেয়। প্রকৃত অপরাধীর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে তাদের বিশ্বাসের কথাও তারা জানিয়ে দেয়। এ ছাড়া পিটিয়ে, কুপিয়ে, ছুরিকাঘাতে, রগ কেটে জখম বা পঙ্গু করে দেওয়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হল দখল, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ছাত্রী নিপীড়ন, শিক্ষক লাঞ্ছনা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত অপরাধীর সংখ্যা হিসাব করলে কয়েক শ নয়, কয়েক হাজার হবে সন্দেহ নেই—ছাত্রছাত্রীরা বলে চলে।
পাঠক, আপনারা জানেন, আমাদের দেশের কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিক কোনো নাম নেই। তাদের নামের আগে পশুপাখি বা নানা ধরনের বিষয় যোগ করে ডাকা হয়। এ রকম কয়েকজন সন্ত্রাসীর নাম করে ছাত্রছাত্রীরা দাবার শেষ চালে রাজাকে চারদিক থেকে আটকে ফেলার মতো আমাকে প্রশ্ন করতে থাকে। তারা প্রশ্ন করে, জন্মের সময় কেউ, যেমন: কানা বক্কর, কান কাটা রমজান, ফাইভ স্টার জসিম কিংবা কুত্তা জহির নাম ধারণ করে হাতে একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময়ও তো কেউ ঘাতক, ভ্রাতৃহন্তারক, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ বা দাগি অপরাধী হিসেবে ভর্তি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এদের অনেকেই ভ্রাতৃহন্তারক, নৃশংস খুনি বা ঘৃণ্য অপরাধী হয়ে ওঠে। তাহলে কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাতক হওয়ার, চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ হওয়ার প্রশিক্ষণ হয়? কিন্তু কেন? আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো স্বায়ত্তশাসিত। স্বায়ত্তশাসন মানেই তো রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র। তা হলে কি আমাদের স্বায়ত্তশাসনে বড় রকমের গলদ রয়েছে, যা অপরাধী তৈরিতে সহায়তা করছে?
ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমার মস্তিষ্ক কয়েক গুণ সক্রিয় হয়ে ওঠে অনুভব করি। আমার সমস্ত সত্তায় অনুরণন হতে থাকে, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর উচ্চশিক্ষা সেই মেরুদণ্ডের অস্থি-মজ্জা। জাতির মেরুদণ্ডে অস্থি-মজ্জা সরবরাহকারী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে হত্যাকারীদের অভয়ারণ্য হয়? মুহূর্তেই একটি ঘটনা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
প্রিয় পাঠক, বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩টি বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মধ্যে লিখিত প্রশ্নমালার মাধ্যমে যে জরিপ পরিচালনা করা হয়, তাতে ক্রমেই ফিকে হয়ে যাওয়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নিদারুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের ৭৯ শতাংশ বর্তমান একাডেমিক কার্যক্রমে সন্তুষ্ট নন বলে মত দিয়েছেন। প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রতি অসন্তুষ্টি জানিয়েছেন ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা। মাত্র ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, শিক্ষাদান পদ্ধতি অংশগ্রহণমূলক। ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তাঁদের বিভাগে সেশনজট আছে। মাত্র ২ শতাংশ মনে করেন, নির্ধারিত সময়ে কোর্স সম্পন্ন হয়। আর ৩ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, যথাসময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। বর্তমান আকৃতি ও প্রকৃতির ছাত্ররাজনীতিকে ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা সমর্থন করেননি।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুুর্নীতি, স্বরূপ ও প্রতিকার’ বিষয়ে গবেষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষদের কয়েকটি বিভাগের দুই সপ্তাহের মোট ক্লাস এবং অনুষ্ঠিত ক্লাসের ওপর যে জরিপ করেছেন, তাতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষদের কয়েকটি বিভাগে দুই সপ্তাহে মোট ক্লাস ছিল ১৩১টি, অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫২টি। যার অর্থ দাঁড়ায়, ৩৯.৫৯ শতাংশ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ৬০.৪১ শতাংশ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সপ্তাহে মোট ক্লাস ছিল ১২৩টি, অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫৯টি। অর্থাৎ ৪৭.৫ শতাংশ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ৫২.৫ শতাংশ ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়নি।
জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুশীলন ও কার্যকর শিক্ষা অর্জনের সঙ্গে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে অনেক আগেই। শিক্ষার্থীদের এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যেটুকু সম্পর্ক আছে, তা কেবল ২০-২৫টি প্রশ্ন মুখস্থ করে সার্টিফিকেট অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ছাত্রছাত্রীদের এমন কথায় আমার সংবিৎ ফিরে আসে। অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জেনেছি, অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী চার-পাঁচ বছরের প্রশ্নপত্র থেকে ২০-২৫টি প্রশ্নের একটি সাজেশন তৈরি করে, যা দিয়ে খুব অনায়াসেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাস করা যায়। ফলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষা অর্জনের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা আরও জানিয়েছে, কোনো একাডেমিক চাপ না থাকায় এবং কম পড়াশোনা করে পাস করা যায় বলে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী সারা বছর পড়াশোনা না করে কেবল পরীক্ষার আগে কিছু দিন টানা পড়াশোনা করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ থাকায় সারা বছর অফুরন্ত অলস সময় কাটাতে গিয়েই কি আমাদের ছাত্রছাত্রীরা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে?
আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যদি পড়াশোনায় স্বাদ পেত, তাহলে তারাও নিজ নিজ বিষয়ের পাশাপাশি একুশ শতকের জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির যুগে সৃষ্টিশীল অধ্যয়ন ও গবেষণায় ব্যাপকভাবে যুক্ত হতো। এই সৃষ্টিশীল ও ক্রমশ সম্প্রসারণশীল জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ফলে ঘাতক, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ তৈরির প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো প্রশিক্ষণার্থীর অভাবে আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যেত। ঘাতকেরা পবিত্র শিক্ষাঙ্গনের ত্রিসীমানা ছেড়ে পালিয়ে যেত।
মো. জাকির হোসেন: আইন অনুষদের ডিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
zhossain@justice.com

No comments

Powered by Blogger.