দূরদেশ-লিবিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কা by আলী রীয়াজ

লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলন কেবল যে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র অভ্যুত্থানেই পরিণত হয়েছে তা নয়, জাতিসংঘের অনুমোদিত ‘নো-ফ্লাই জোন’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তা এখন একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে রূপ নিতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।


লিবিয়ায় এরই মধ্যে বিমান হামলা শুরু হয়েছে। শনিবার ফ্রান্সের অন্তত ২০টি যুদ্ধবিমান লিবিয়ার আকাশসীমায় ঢোকে।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর অনেকেই আশাবাদী ছিলেন, মিসর ও তিউনিসিয়ার মতো এখানেও গণ-অভ্যুত্থান হবে স্বল্পমেয়াদি এবং গাদ্দাফির পতন কেবল অবশ্যম্ভাবীই নয়, অত্যাসন্নও বটে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ বহু দেশ খোলামেলা সমর্থন দিতে দেরি করলেও খুব কম সময়ের মধ্যেই তারা গাদ্দাফির ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষী লিবীয়দের প্রতি মৌখিক সমর্থন, গাদ্দাফির পদত্যাগ দাবি এবং আন্তর্জাতিক চাপ অবস্থার বদলে যথেষ্ট বলে মনে করলেও পশ্চিমা দেশগুলো পরে বুঝতে পারে, গাদ্দাফি সহজে ক্ষমতা ছাড়ার পাত্র নন। দেশের ভেতর ‘বিদ্রোহী’রা প্রথমদিকে দ্রুত সাফল্য লাভ করে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে অগ্রসর হয়ে রাজধানী ত্রিপোলির দরজায় গিয়ে হাজির হয়। আন্তর্জাতিক সমাজ অপেক্ষা করছিল, তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়াই সমস্যার সমাধান হবে—বিদ্রোহীরা ত্রিপোলিতে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু উল্টো গাদ্দাফি তাঁর বাহিনী নিয়ে চড়াও হয়ে দিন দশেকের মধ্যে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি বেনগাজির উপকণ্ঠে আসতে সক্ষম হন। অগ্রসরমাণ ও সামরিকভাবে শক্তিশালী গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীকে রুখতে বিদ্রোহীরা বারবার সাহায্যের আবেদন জানায়। কীভাবে বিদ্রোহীদের সাহায্য করা যায়, তার কৌশল তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ এতটাই সময় ব্যয় করে ফেলে যে শেষাবধি বিদ্রোহীদের রক্ষা করাই হয়ে ওঠে প্রধান কাজ।
পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিধা ও দোদুল্যমানতার কারণ ছিল বহুবিধ। কোনো পশ্চিমা দেশ কিংবা ন্যাটো এককভাবে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে যেতে রাজি ছিল না। ওবামা প্রশাসন লিবিয়ার এই সংঘাতে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়তে অনুৎসাহী ছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় কারণেই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও দুটি যুদ্ধে জড়িত থাকার কারণে এই যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রায় অসম্ভব। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিনরা আরও একটি সংঘাতে জড়ানোর পক্ষে যাবে না। যার অর্থ হলো, ২০১২ সালে ওবামার পুনর্নির্বাচনের জন্য তা হবে ক্ষতিকর। আন্তর্জাতিকভাবে ওবামা প্রশাসন আর কোনো মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে হামলার সূচনা করতে উৎসাহী ছিল না। কেননা, তাতে করে ওবামার গত দুই বছরের অনেক বক্তব্যই সমালোচনার মুখে পড়ে যাবে। তদুপরি বাহরাইন ও ইয়েমেনে সরকারের শক্তি প্রয়োগ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র যখন ওইসব সরকারের ওপর প্রত্যক্ষ চাপ দিচ্ছে না, তখন লিবিয়ায় সামরিক-ব্যবস্থার সমর্থন করাটা ছিল অসংগত। কিন্তু বিদ্রোহীদের ঘাঁটিই যখন পতনের পথে এবং ফ্রান্স ও ব্রিটেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা শুরু করে, তখন তাদের পক্ষে ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ সম্ভব হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আশা করছিল, মুসলিম দেশগুলো এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট ও কঠোর ভূমিকা নেবে। আরব লিগের পক্ষ থেকে নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার দাবি উঠলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
পশ্চিমা দেশগুলোর দোদুল্যমানতার আরেকটি অন্যতম কারণ ছিল, বিদ্রোহীদের সমর্থন ও সাহায্যের ধরন কী হবে, তা নির্ধারণ করতে না পারা। লিবিয়ার বিদ্রোহীরা বারবার দাবি জানিয়েছে, তাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হোক। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদ্রোহীরা একটি যুদ্ধে লিপ্ত; ফলে কার্যকর সমর্থন বলতে কেবল নৈতিক সমর্থনই যথেষ্ট নয়। দরকার অস্ত্র, যা দিয়ে তারা গাদ্দাফি বাহিনীকে মোকাবিলা করতে পারবে। বিদ্রোহীরা অন্ততপক্ষে গত সপ্তাহ পর্যন্ত জোর দিয়ে বলেছে যে তারা বিদেশি কোনো বাহিনীর আগ্রাসন সমর্থন করে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কংগ্রেসে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, বিদ্রোহীরা লিবিয়ায় বিদেশি সেনা দেখতে চায় না। সপ্তাহখানেক আগেও যদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা যেত এবং নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠিত হতো, তবে বিদ্রোহীরা তাদের এলাকায় পাল্টা সরকার তৈরির সুযোগ পেত। এখন সে পরিস্থিতি নেই।
লিবিয়ায় বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নো-ফ্লাই জোন বাস্তবায়ন। ইতিমধ্যে তা শুরু হয়েছে, কিন্তু গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর সাঁজোয়া বহর অগ্রসর হচ্ছে এবং গাদ্দাফি যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার ভান করছেন মাত্র। ফলে আজদাবিয়া থেকে বেনগাজি পর্যন্ত ‘নো-ড্রাইভ জোন’ তৈরি করতে হবে। গাদ্দাফি বাহিনীর আক্রমণের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে টি-৭২ ট্যাংক এবং বিএম-২১ রকেট আর্টিলারি। এগুলোর চলাচল বন্ধ করতে হলে বোমা বর্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কোনো কোনো সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, ট্যাংক ও সাঁজোয়া বহরের পাশাপাশি বেসামরিক যানবাহনেও গাদ্দাফির অনুগতরা এগোচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ফরাসি (বা অন্য কোনো দেশের) বিমান বেসামরিক যানে হামলা চালাবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। এ ধরনের হামলায় বেসামরিক মানুষ নিহত হবে, যার সমালোচনায় মুখর হবে গোটা বিশ্ব এবং তা এ অভিযানের প্রধান উদ্দেশ্য ‘নাগরিকদের রক্ষা করার’ সঙ্গে সংগতিপূর্ণও হবে না। তা ছাড়া যুদ্ধ-কৌশলের বিবেচনায় বিমানবিধ্বংসী কামান এবং সামরিক ইউনিটগুলোই প্রধান লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কথা।
নো-ফ্লাই জোন বাস্তবায়নে আরব লিগের দুটি দেশ অংশ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কার্যকরভাবে অব্যাহত নো-ফ্লাই জোন বহাল রাখতে পশ্চিমা দেশগুলোর একটি অভিন্ন কমান্ড তৈরি থাকার কথা। ভুলে গেলে চলবে না, এগুলো হচ্ছে আশু ব্যবস্থা, কেবল বিদ্রোহীদের রক্ষা করার পদক্ষেপ। গোড়ায় যেমনটি বলেছি, আমার ধারণা এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের সূচনামাত্র। লিবিয়ায় বিদ্রোহের সাফল্য নির্ভর করবে বিদ্রোহীদের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি এবং তাদের হাতে সরবরাহ পৌঁছে দেওয়ার ওপর।
বিদ্রোহীদের দাবি অনুযায়ী তাদের অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এখন একটি বিকল্প।
গাদ্দাফি সরকারের যে ৩২ বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে আটক করা হয়েছে, তা বিদ্রোহীদের হাতে তুলে দিলে তারা অস্ত্র কিনতে সক্ষম হবে। কিন্তু এ ধরনের সম্ভাবনা অনেককেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহের পরিণতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। ১০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানদের অস্ত্র সরবরাহ করে, পরে তাদের মধ্য থেকেই ওসামা বিন লাদেনের উত্থান। শুধু তা-ই নয়, এসব অস্ত্রের সূত্রেই পাকিস্তানে সৃষ্টি হয় অস্থিতিশীলতা, যার মাশুল গুনছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র। তদুপরি মনে রাখা দরকার, গাদ্দাফি সোভিয়েত বাহিনীর মতো বাইরে থেকে আসা শক্তি নয়। গত ৪১ বছরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গাদ্দাফি বিভিন্ন ধরনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে অর্থ জোগান দিয়েছে। লিবিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা যে এগিয়ে আসতে পারে, তার সম্ভাবনা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। গাদ্দাফি ১৪ মার্চ ইতালির একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই বলেছেন, বিদেশিদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে যোগ দিয়ে ‘ধর্মযুদ্ধে’ শামিল হবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত বিদ্রোহী বাহিনীকে ‘বিদেশিদের আগ্রাসন’ বলে বর্ণনা করে সুদান, মালি, নাইজার থেকে অর্থের বিনিময়ে ভাড়াটে বাহিনী জোগাড় করা গাদ্দাফির জন্য খুব কষ্টকর হবে না।
দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে, ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর কসোভো অভিযানের মতো বিমান হামলা চালানো এবং তার পরে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা। কসোভো অভিযান পরিচালিত হয়েছিল জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়া এবং কোলমান ন্যাটোর উদ্যোগে। এ অভিযানের সুফল কসোভোর নাগরিকেরা ভোগ করলেও যুক্তরাষ্ট্র তার জন্য সমালোচিত হয়েছে। ওই হামলায়ও বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। স্বল্প মেয়াদে যুদ্ধ শেষ করার ইচ্ছা থেকে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে তার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন কতটা থাকবে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি সদস্য দেশ—রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ভারত ও ব্রাজিল নো-ফ্লাই জোন ও সামরিক ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দেয়নি। তদুপরি আঞ্চলিক সংস্থা আফ্রিকান ইউনিয়ন যেকোনো ধরনের সামরিক ব্যবস্থারই বিরোধিতা করছে। যে দুটি বিকল্পের কথা আমি আলোচনা করেছি, সেগুলোর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সামরিকভাবে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর স্থলে বিদ্রোহীদের ক্ষমতাসীন করা। কিন্তু এর বাইরে আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কি না, তা ভাবার বিষয়। বিদ্রোহীদের ওপর গাদ্দাফির অনুগতদের আক্রমণ বন্ধের পর সে উদ্যোগের কথাও উঠবে। সে ক্ষেত্রে হয় মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হবে, যার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে অথবা লিবিয়া বিভক্ত করে দুটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গাদ্দাফি ও তাঁর অনুগতরা সেটা মানতে রাজি হবে, এমন কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যায়নি। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপরই তার সম্ভাবনা নির্ভর করবে। এগুলোর বাইরে সমাধান হলো, মুয়াম্মার গাদ্দাফির বাহিনীর বিজয়। যার পরিণতি হবে বেনগাজিসহ লিবিয়ার অন্যত্র ব্যাপকসংখ্যক নাগরিকের মৃত্যু, সম্ভবত গণহত্যা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখের সামনে, তাদের প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ সত্ত্বেও যদি পরিস্থিতি তা-ই হয়, তার প্রভাব কেবল লিবিয়ায়ই সীমিত থাকবে না।
ইলিনয়, ১৯ মার্চ, ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.