খোলা চোখে-আর্চার ব্লাড: একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি by হাসান ফেরদৌস

শর্মিলা বসু নামের এক বাঙালি ‘গবেষক’ দাবি করেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা হয়নি। ৩০ লাখ বাঙালি নিধনের যে ইতিহাস অথবা হাজার হাজার বাঙালি নারী ধর্ষণের কাহিনি, তা সত্য নয়। সরেজমিনে তদন্ত করে, বিস্তর কাগজপত্র ঘেঁটে তিনি নাকি এই ‘ঐতিহাসিক তথ্য’ উদ্ধার করেছেন।


কিন্তু শর্মিলা নয়, আমি একজন মার্কিন কূটনীতিকের কথা বলার জন্য কলম ধরেছি। একাত্তরের গণহত্যার তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী। একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা হামলার পর তিনিই প্রথম ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
তাঁর নাম আর্চার ব্লাড।
১৯৭১ সালে আর্চার ব্লাড ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ও তার পরবর্তী সময়ে অবরুদ্ধ ঢাকায়, তার আশপাশে কী ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটে, তিনি তার প্রত্যক্ষদর্শী। কনস্যুলেট অফিসে সে সময় একাধিক সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, তথ্য অধিকর্তাও ছিলেন। খবর সংগ্রহের কাজে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে তথ্য সংগ্রহের নানা উপায় আর্চার ব্লাডের জানা ছিল। ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেন তিনি। নিজের চোখে ঢাকার রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। তথ্যভিত্তিক সেসব বিবরণ তিনি নিয়মিত পাঠাতেন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ‘অতি গোপনীয়’ এসব প্রতিবেদন কয়েক বছর আগে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সে সবই এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
পরবর্তী সময়ে ব্লাড নিজেও সেই গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকথা দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ গ্রন্থে। সে গ্রন্থে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি হামলার হূদয়বিদারক বিবরণ। রয়েছে রোকেয়া হল ছাত্রীবাসে হামলার ফলে নিহত ও লাঞ্ছিত ছাত্রীদের কথা। ২৮ মার্চ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে তিনি লিখেছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনী আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে তাঁদের ঘরে ঘরে হামলা চালাচ্ছে। সংখ্যালঘুরা যে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসরদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য, সে কথাও সে প্রতিবেদনে তিনি লিপিবদ্ধ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে, ব্লাডের কথায়, তা ‘বেছে বেছে গণহত্যা’ (সিলেক্টিভ জেনোসাইড) ভিন্ন অন্য কিছু নয়। ‘ঢাকায় যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে তা দেখে আমরা হতবাক ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছি।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সে প্রতিবেদনে তিনি জানান, সবকিছু স্বাভাবিক ও শান্ত রয়েছে—পাকিস্তান সরকারের এই মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস না করে, ব্যক্তিগতভাবে হলেও মার্কিন সরকারের উচিত, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই ‘বেছে বেছে গণহত্যা’র প্রতিবাদ জানানো।
শর্মিলা বসুকে আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি কি আর্চার ব্লাডের সে প্রতিবেদন পড়েছেন? বাঙালির দেওয়া বিবরণ না হয় আপনার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হলো, কিন্তু মার্কিন কনসাল জেনারেলের সরেজমিনে বিবরণকে কী বলবেন? একাত্তরে পাকিস্তানি হামলাকে তিনি কেন ‘জেনোসাইড’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তা বোঝার কোনো চেষ্টা আদৌ করেছেন কি?
শুধু আর্চার ব্লাড নয়, ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটে সে সময় যাঁরা কর্মরত ছিলেন, তাঁরা অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিকার গণহত্যায় তাঁদের ঘৃণা প্রকাশ করেন, মার্কিন সরকারের উদাসীনতায় তাঁদের তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটের ২০ জন সদস্য যৌথভাবে এক টেলিগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সংঘটিত গণহত্যায় ওয়াশিংটনের নীরবতায় প্রতিবাদ করে তাঁদের ‘ভিন্নমত’ প্রকাশ করেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর উইলিয়াম রজার্স মার্কিন কূটনীতিকেরা যাতে খোলামেলাভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন, সে জন্য একটি ‘ডিসেন্ট চ্যানেল’ খোলার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার কূটনীতিকেরা এই ‘ডিসেন্ট চ্যানেল’-এর সুযোগ গ্রহণ করেই মার্কিন নীতির প্রতি তাঁদের অসম্মতির কথা তীব্র ভাষায় প্রকাশ করেন। একই দিন অর্থাৎ ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের আরও নয়জন কর্মকর্তা ঢাকা থেকে পাঠানো সে তারবার্তার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিল রজার্সের কাছে একটি ভিন্ন চিঠি লেখেন।
‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে এই তারবার্তাটি ইতিমধ্যে নানা সময় উদ্ধৃত হয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে সেটির অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছি:
‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র দমন ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার নিজের নাগরিকদের রক্ষা করতে ব্যবস্থা গ্রহণেও সে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ একই সময়ে তারা পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারকে আগ বাড়িয়ে সমর্থন জুগিয়েছে এবং তাদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যে আন্তর্জাতিক নিন্দা হয়েছে, তার ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাসে উদ্যোগী হয়েছে...সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট যেখানে বার্তা পাঠিয়েছেন গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এবং (পূর্ব পাকিস্তানের) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করে, সেখানে আমাদের সরকারের এই ভূমিকা নৈতিক দেউলিয়াপনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।...আমাদের সরকার (সেনা অভিযানের ব্যাপারে) হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই যুক্তিতে যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে বিবাদ, যার ব্যাপারে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও বহু ব্যবহূত গণহত্যা শব্দটি প্রযোজ্য (তা নাকি) এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। মার্কিন নাগরিকেরা এই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা পেশাদার কূটনীতিকেরাও এই নীতির সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করছি।’
মার্কিন কূটনীতিকেরা যে এই প্রথম তাঁদের ভিন্নমত প্রকাশ করলেন, তা নয়। কিন্তু ক্রিস্টোফার হিচেনসের কথায়, এত কঠোর ভাষায় আর কখনোই মার্কিন কূটনীতিকেরা তাঁদের ভিন্নমত প্রকাশ করেননি। হিচেনস তাঁর দি ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার গ্রন্থে এই তারবার্তার গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কনস্যুলেটের একটি রেডিও ট্রান্সমিটারের সাহায্যে আর্চার ব্লাড নিয়মিতভাবে পাকিস্তানি গণহত্যার প্রতিবেদন ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠান, কিন্তু নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সেসব প্রতিবেদন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গণহত্যার নীরব সমর্থনে যে ভূমিকা কিসিঞ্জার গ্রহণ করেন, সে জন্য হিচেনস তাঁর বিচার দাবি করেছেন।
শর্মিলা বসু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গণহত্যার কোনো প্রমাণ নেই বলে দাবি করেছেন। ব্লাডের বইটি পড়লে—অথবা তাঁর তারবার্তা অনুসরণ করলে—সে সত্য তাঁর গোচরে আসত। পাকিস্তানি সামরিক অভিযানকে কেন ‘জেনোসাইড’ বলা হলো, ব্লাড তাঁর ব্যাখ্যা হিসেবে লিখেছেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিধনের ব্যাপারে যে পরিকল্পিত অভিযান চলেছে, তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি চিফ সেক্রেটারি (শফিউল আজম) সেনা অধিকর্তাদের দেওয়া যুক্তি তুলে ধরে তাঁকে জানান, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা বরাবরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে গেছে। ‘হিন্দুদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে, সে কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও সচিব মহোদয় অবশেষে স্বীকার করলেন, সেনা হামলায় হিন্দুদের চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এই হামলার পুরোটাই একটি নীলনকশা অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে।’
শর্মিলা বসু কি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কী এই নীলনকশা? এই নীলনকশার আওতায় কত লাখ নিরীহ মানুষকে বলি দেওয়া হয়েছে?
ব্লাড লিখেছেন, ভিন্নমত প্রকাশ করে পাঠানো তারবার্তাটি তিনি হয়তো কিছুটা নরম করে দিতে পারতেন, কিন্তু তা করেননি, কারণ সে তারবার্তায় স্বাক্ষরকারী সব দূতাবাস কর্মকর্তার মতো ‘আমিও [পররাষ্ট্র বিভাগ] পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ না করায় বিস্মিত ও আহত হয়েছিলাম।’ বলা বাহুল্য, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার তাঁদের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে এমন সরাসরি চ্যালেঞ্জ প্রকাশ করায় ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। তাঁরা উভয়ে তখন ব্যস্ত চীনের সঙ্গে গোপন দূতিয়ালিতে। মার্কিন পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী জোসেফ সিসকো ঢাকায় আর্চার ব্লাড ও তাঁর সহকর্মীদের ‘বিদ্রোহে’র কথা জানালে কিসিঞ্জার সরাসরি জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের ব্যাপারে প্রশাসনের নীতি পরিবর্তনের কোনো আশা নেই। যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করছেন, কিসিঞ্জার তাঁদের ‘সোজাপথে’ আসার পরামর্শ দেওয়ার জন্য সিসকোকে নির্দেশ দিয়েছেন।
বলা বাহুল্য, আর্চার ব্লাডকে তাঁর এই ‘ঔদ্ধত্যের জন্য’ বড় ধরনের মূল্য দিতে হয়। কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথা হোয়াইট হাউস ইয়ার্স-এ স্বীকার করেছেন, ক্ষিপ্ত নিক্সন ব্লাডকে ঢাকা থেকে অবিলম্বে বদলির নির্দেশ দেন। সে ঘটনার পর আরও ছয় বছর কিসিঞ্জার আমেরিকার বৈদেশিক নীতির কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই ছয় বছর ব্লাড কোনো কূটনৈতিক দায়িত্ব পান না। তাঁকে একের পর এক ছোটখাটো প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করা হয়। ব্লাড লিখেছেন, এই পুরো সময়টা ছিল তাঁর জন্য এক অসহনীয় অভিজ্ঞতা।
নিক্সন ও কিসিঞ্জার রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে যাওয়ার পর আর্চার ব্লাড অবশ্য ফের কূটনৈতিক দায়িত্ব ফিরে পান। ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণের আগে তিনি নয়াদিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০২ সালে ব্লাড যখন তাঁর স্মৃতিকথা দি ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ লিখে শেষ করেন, তখনো একাত্তরে পাকিস্তান গণহত্যার প্রতি মার্কিন প্রশাসনের ঔদাসিন্যে তিনি বিবেকের দংশনে ভুগছেন। ব্লাড লিখেছেন, এই বই লিখতে গিয়ে বারবার তাঁর চোখ ভিজে এসেছে অশ্রুতে। ‘আমি চোখের জলে ভিজেছি যখন মনে পড়েছে সেসব বাঙালি বন্ধুর কথা, যারা স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছে, যখন ভেবেছি কী প্রবল নির্যাতনের ভেতর দিয়ে এই সাহসী জাতিকে (একাত্তরে) সময় অতিক্রম করতে হয়েছে।’
২০০৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আর্চার ব্লাড দেহত্যাগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে কজন বিদেশি বন্ধুকে আমরা কাছে পেয়েছিলাম, তিনি তাঁদের একজন। স্বাধীনতার ৪০ বর্ষ পূর্তির এই মুহূর্তে শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় সেই বন্ধুর কথা স্মরণ করছি।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.