ক্ষুদ্রঋণ-গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূস by মোহীত উল আলম

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে আমি প্রথম শুনি ১৯৬৪ সালে। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। তিনি একই স্কুল থেকে বহুকাল আগে পাস করেছিলেন। স্কুলের কারণে আমি তাঁর কথা শুনিনি, শুনেছিলাম অন্য একটি প্রসঙ্গে। ড. ইউনূস নাকি আমেরিকা থেকে তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন।


সে সময় ছিল ট্রাংক কলের যুগ। চট্টগ্রাম থেকে সামান্য দূরত্বে কাপ্তাইয়ে কথা বললেও ট্রাংক কলে কথা বলতে হতো। সে জায়গায় আমেরিকা থেকে কথা বলা! এখনকার ভাষায়, এটা তখন চট্টগ্রাম শহরের টক অব দ্য টাউন হয়েছিল।
ড. ইউনূস সম্পর্কে আমার মনে এখনো এ ঘোর লাগার ব্যাপারটা আছে। চট্টগ্রামের লোকেরা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার লোকদের চেয়ে অনেক বেশি পরিবারবাদী লোক। সে জন্য ড. ইউনূস প্রথমে, এবং পরে তাঁর ভাইয়েরা একে একে সুনাম অর্জন করলে, পরিচয় একটাই থাকল যে এঁরা হাজি দুলা মিঞা সওদাগরের ছেলে। হাজি দুলা মিঞা সওদাগর, বলা বাহুল্য, তাঁর আমলে সবচেয়ে নামকরা স্বর্ণ ব্যবসায়ী ছিলেন। পাঁচলাইশ এলাকায় তাঁর তৈরি নিরিবিলি নামে চারতলা বাড়িটি সৌন্দর্যে ও আভিজাত্যে একটি পথিকৃৎ বাড়ি ছিল। তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হলেও খুব কৃচ্ছ্র সাধন করে চলতেন। ড. ইউনূস তাঁকে চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে দেওয়া একটি নাগরিক সংবর্ধনায় (তখনো তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি) সশ্রদ্ধ চিত্তে পিতার এ গুণটির কথা স্মরণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তাঁর দারিদ্র্যমুক্তির ব্রত নেওয়ার পেছনে পিতার আজীবন চর্চাটি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আমার তেমন খোঁজখবর না থাকলেও, দুজন বন্ধুর কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে আমার একটি দূর-সম্পর্ক বজায় থাকে। একজন হলেন জান্নাতে কাউনাইন, যিনি আমার ইংরেজিতে সহপাঠী ছিলেন। তিনি এখন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রচার দপ্তরের প্রাধ্যক্ষ। যখন মেয়েরা শিক্ষকতা করা ছাড়া অন্য কোনো চাকরির চিন্তা করত না, তখন জান্নাত গ্রামীণ ব্যাংকে যোগ দেন এবং দেখা হলেই গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুদায়িত্ব পালনের কথা বলতেন। শুনে ভালো লাগত যে জান্নাত ব্যাংকিং জগতে নারী কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। আজকাল ব্যাংকিংয়ে নারী ভূরি ভূরি, কিন্তু জান্নাতদের ওঠার সময় এ পদচারণ ছিল খুব ক্ষীণ।
আমার দ্বিতীয় বন্ধু হলেন এমদাদুল হক। তিনি মুহসীন হলে আমার রুমমেট ছিলেন। হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র। পাস করে গ্রামীণ ব্যাংকে যোগ দেন। পরে চাকরি ছেড়ে আফ্রিকার কোনো একটা দেশে চাকরি করতে যান। একদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হলেন। বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে ড. ইউনূস ব্যাপারটি জানতে পেরে চিকিৎসার জন্য তাঁকে আমেরিকায় পাঠান। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর আমার সে বন্ধু মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলেও চিরজনমের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। তাঁর কোমর থেকে নিচে আর কোনো স্পর্শবোধ থাকে না। ড. ইউনূস তাঁকে বিদেশ থেকে নিয়ে এসে গ্রামীণ ফান্ডের জিএম পদে নিয়োগ দিলেন। একটি সার্বক্ষণিক মাইক্রোবাসসহ দুজন পরিচারক দিলেন, যাঁরা তাঁকে হুইলচেয়ারে গাড়ি থেকে ওঠান এবং গাড়ি থেকে নামান। আমার এ বন্ধু ভয়ানক রকম পঙ্গু হলেও তাঁর জীবনযাত্রা কোথাও থেমে নেই। এ বন্ধুর স্ত্রী সরকারি দলের একজন নির্বাচিত সাংসদ।
তো এবার যখন ড. ইউনূসের সংকট যাচ্ছিল তখন গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোগে তাদের ভূমিকার পক্ষে অনলাইন প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। জান্নাতের মেইল প্রতিদিন পেতে লাগলাম—এ পেপার কাটিং, সে পেপার কাটিংয়ের। এর মধ্যে বেশির ভাগ হচ্ছে বিদেশের পত্রপত্রিকাগুলো—ড. ইউনূস ও তাঁর ব্যাংকের কী রকম সুখ্যাতি গাইছে, তার বিবরণ। একদিন এল আটলান্টা নামে অতি অল্প পরিচিত একটি পত্রিকার কাটিং। খানিকটা বিরক্ত হয়ে জান্নাতকে তাৎক্ষণিক একটি প্রত্যুত্তর দিলাম। বললাম, এটিই হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রচার-ধারণার সমস্যা। গ্রামীণ ব্যাংক বা ড. ইউনূসকে নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশে—কোনো বিভ্রান্তি নেই। বিভ্রান্তি আছে দেশের ভেতরে (ফেসবুকে অনেকে আমাকে এই বিভ্রান্তির কথা জানাচ্ছেন। একজন ১৯ বছরের বান্ধবী বলেছেন, কোনটা সত্য বুঝতে পারছেন না)। বললাম, প্রধানমন্ত্রী যখন ধারণা করলেন যে গ্রামীণ ব্যাংক গরিব লোকদের রক্ত চুষে ব্যবসা করছে, তখন ড. ইউনূস বা গ্রামীণ ব্যাংক প্রামাণিক জবাব দেওয়ার পথে না গিয়ে ড. ইউনূস টিভিতে এসে বললেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত এবং এটা প্রকাশ করার তাঁর অধিকার আছে। অথচ সাধারণ জ্ঞানে বলছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য একটি প্রতিনিধিত্বমূলক বক্তব্য, শুধু ব্যক্তিগত বক্তব্য হতে পারে না। দেশের একাংশের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে এই বিভ্রান্তি আছে বলে অনুরূপ বক্তব্য বের হয়ে এসেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে গ্রামীণ ব্যাংকের তরফ থেকে পত্রপত্রিকায় ও টিভিতে সয়লাব করে দেওয়া উচিত ছিল এমন এমন প্রতিবেদন, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝত যে এরা গরিবের রক্ত চোষে না, গরিবের হেফাজত করে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সংকটটা তৈরি হয়েছে, আমার মতে, ইমেজ তৈরি করাতে তাদের ভুল ধারণা নিয়ে অগ্রসর হওয়াতে। ড. ইউনূস যখন ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন দেশের শক্তিশালী বামপন্থী কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমর সমকাল পত্রিকায় এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর জনপ্রিয় কলামগুলোতে সিরিজ লিখে জাতিকে জানালেন, আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠানে বিরাট অঙ্কের চাঁদা প্রদানের বিনিময়ে ড. ইউনূস নোবেলটা পান এবং ড. ইউনূসকে নাকি দেশে বিপ্লব প্রতিরোধ করার জন্য বিদেশি শক্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এঁদের দুজনের কলামে শুধু আবেগ থাকলে কথা ছিল না, ছিল যথেষ্ট যুক্তি, তর্ক ও তথ্য। এঁরা যে ড. ইউনূসকে বাজার অর্থনীতির ছায়ায় পুঁজিবাদী অর্থনীতির নব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রতিনিধি বলেছিলেন বা বলেছিলেন, দারিদ্র্য উপশমের নামে মানুষের প্রতিবাদী চেতনা হরণ করার প্রয়াসে নেমেছেন—তারও সুষ্ঠু জবাব আজ পর্যন্ত সাধারণভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের তরফ থেকে দেওয়া হয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি।
এখন ড. ইউনূসকে হিলারি ক্লিনটনের পাশে বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছবি ওঠাতে দেখে বাংলাদেশের শিক্ষিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহল উল্লসিত বা ক্ষেত্রবিশেষে ঈর্ষান্বিত হতে পারে, কিন্তু এ ছবিগুলো ঠিক গ্রামীণ ব্যাংকের দারিদ্র্য দূরীকরণের দর্শনের পক্ষে কথা বলে মনে হয় না। যদি ধরেও নিই যে প্রধানমন্ত্রী এক-এগারোতে ড. ইউনূসের ভূমিকার কারণে তাঁর ওপর আক্রোশ পোষণ করেন, তার পরও এ কথা তো থাকে যে তিনি যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সে দেশের বেশির ভাগ লোক এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দরিদ্র দেশের প্রধানমন্ত্রীর সে দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য নোবেলজয়ীর কাছে দু-একটি প্রশ্ন থাকতেও পারে। তাঁর প্রশ্নটি অন্যদের মনেও যে নেই, তা নয়।
এবারের সংকটের সময় একটি খবর এসেছে, ড. ইউনূসকে নিয়ে হয়রানির ব্যাপারে মার্কিন সিনেটর জন কেরি উদ্বিগ্ন। এটা যখন প্রচারিত হয়, তখন সাধারণ মানুষের মনে যে অনাকাঙ্ক্ষিত তুলনাটি ছায়া ফেলে তা হলো, মার্কিন সিনেটররা কখনো তাঁদের স্বার্থ ছাড়া উদ্বিগ্ন হন না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার একদিন আমাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেছিলেন। সেই অপমানটা আমরা গায়ে মাখার অনেক দিন পরে বুঝেছিলাম, ওই উক্তিটাতে শুধু শয়তানি ছিল না, ছিল সত্যের অপলাপও।
তাই জান্নাতকে লিখেছিলাম যে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে বিদেশি প্রচার যতই জোরদার হচ্ছে, ততই দেশের ভেতরের লোকের সন্দেহ বাড়ছে।
সাদা চোখে আরেকটা জিনিস ধরা পড়ে। দারিদ্র্যের জন্য কাজ করার সুবর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প অনুসরণ করে গ্রামীণ ব্যাংক তো বটেই, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানও যথেষ্ট অর্থায়ন করছে পল্লিসমাজে। কিন্তু যে জিনিসটি বুঝতে পারি না, কেন ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আন্দোলনে দেশে দারিদ্র্যমোচনের প্রক্রিয়াটি কখনো সমুদ্রসমান দৃশ্যমান হলো না। রাস্তাঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে যেখানে যাই, এটা কখনো চোখে পড়ে না যে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রচেষ্টায় অমুক গ্রামটা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে বা অমুক অঞ্চলের নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হয়েছে। আমি চোখে দেখিনি হয়তো আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে, কিন্তু অন্যরা চোখে দেখছে, তা-ও বলতে বা লিখতে শুনি না। বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করলে পাঠক এ রহস্যাবৃত পার্থক্যটি বুঝতে পারবেন।
তবু আমি মনে করছি, গ্রামীণ ব্যাংক বা ড. ইউনূসের দারিদ্র্য দূরীকরণের স্বপ্নে কোনো অমহৎ কিছু নেই, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, প্রচারকৌশলের মধ্যে তাঁদের যথেষ্ট দুর্বলতা রয়ে গেছে। তাঁরা ভেবেছেন, শুধু বিদেশি সার্টিফিকেটের ওপর নির্ভর করলে চলবে।
ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান হলে কথা ছিল না, কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান নোবেল পেল, যাঁর কর্ণধারও নোবেল পেলেন, তাঁদের উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটে, প্রাকৃতিক সংকটে, শিক্ষার সংকটে, যোগাযোগের সংকটে এবং সর্বোপরি খোদ দারিদ্র্য নিরসনের সংকটে চামচকাটা জল সিঞ্চনের মতো ভূমিকা পালন করলে একটা বিস্ময়বোধ জাগেই।
এ জন্যই প্রধানমন্ত্রীর মনে প্রশ্ন উঠেছে, এ জন্যই বাংলাদেশের মানুষ গ্রামীণ ব্যাংককে বুক পেতে গ্রহণ করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না।
মোহীত উল আলম: বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব।
mohit_13_1952@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.