গোধূলির ছায়াপথে-যা হবার তা হবে by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

পঞ্চাশের দশকে ইউরোপে একটি গান খুব জনপ্রিয় ছিল: ‘কেসারাহ্ সারাহ্, হোয়াটেভার উইল বি, উইল বি’। বাংলা তর্জমা: ‘যা হবার তা হবে’। রবিঠাকুরেরও এ নামে একটি গান আছে। সফররত মার্কিন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক বলে গেছেন আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক হবে মধুর থেকে মধুরতর।


যা বলেননি, তা হলো: আমাদের কথা শুনলে। বড় দেশগুলোর সঙ্গে ছোট দেশগুলোর সম্পর্কের ভিত্তি: আমাদের কথা শোনো। না শুনলে আপত্তি নেই। ‘যা হবার তা হবে’। কোমরে জোর থাকলে অন্য কথা।
জনতার অভ্যুত্থান হলে সংবাদপত্রের পাতায় দৈনিক ঘটনা এমনভাবে স্থান করে নেয় যে পূর্বাপর ঘটনার কারণ বিশ্লেষণের আর অবকাশ থাকে না। অনেক সময় গড়িয়ে গেলে সমকালীন ঐতিহাসিকেরা নানা মালমসলার সমভিব্যাহারে আসল কারণ খুঁজতে বসেন। ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলে ঝানু ঐতিহাসিকেরা বের করে ফেলেন কুশীলবের চরিত্র। সমকালীন ইতিহাস চোখের সামনে এত দ্রুত সংঘটিত টেলিভিশনের পর্দায়, ইন্টারনেটের যুক্তিতক্কোগপ্পো-ভিডিও-ফেসবুক-টুইটার সম্মিলনে, যে এখন আর তদ্দিন অপেক্ষার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। তার সঙ্গে যদি যোগ দেন ওয়েবস্টার টার্পলির মতো ঝানু বিশেষজ্ঞ, তাহলে সহসাই পরিষ্কার হবে পিরামিড স্পিংসের অববাহিকায় অভ্যুত্থানের ঘটনার পেছনে নায়ক কত দ্রুত তার কাজ হাসিল করে ফেলে। নায়ক যে স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্র, ক্রমেই তা স্পষ্ট। ইরানকে শায়েস্তা করতে রাজি হননি হোসনি মোবারক অন্তত ছয়টি ক্ষেত্রে। সবগুলোতেই তিনি বলেছেন, ‘না’। টার্পলি তাঁর আর্টিকেলে পূর্বানুপর সবগুলো ‘না’-এর পর শেষ মার্কিন ‘না’-এর পটভূমি ব্যাখ্যা করেছেন। যাঁরা ইন্টারনেট পড়েন, তাঁদের কাছে নতুন করে বলা অপ্রয়োজনীয়।
ইরানের শাহ মার্কিন কর্মকাণ্ডের সবগুলোতেই সায় দিয়েছেন। একজন কর্মকর্তা এসে জানালেন, ‘পাহ্লভি বংশকে করেছি সুপ্রতিষ্ঠিত, রাজপ্রাসাদগুলো [বারোটি] করেছি সুসংহত, পরিবারের আর্থিক উন্নতিকে করেছি সুসংবদ্ধ। আর কী হলে আপনার মন হবে প্রসন্ন আমেরিকার প্রতি।’ শাহ মৃদু হেসে বললেন, ‘তোমাদের এই সহায়তা জীবন দিয়েও শোধ করতে অসমর্থ আমি। ইরানিদের চেয়েও পেছনে লৌহদণ্ডের মতো এসে দাঁড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। শুধু আরেকটি চাওয়ার আছে আমার, তা হলো: ইরানকে পৃথিবীর একটি বড় শক্তি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত দেখে মরতে চাই।’ বড় শক্তি অর্থাৎ ‘সুপার পাওয়ার’। সিআইএর কর্তাব্যক্তিরা এই কথাটিই শোনার অপেক্ষায়। দুই মাসের মাথায় ইরানের শাহকে গদিচ্যুত করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন। আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে প্যারিস থেকে কারা নিয়ে আসেন, সে কথা অনেকের জানা আছে।
সাদ্দাম হোসেন মার্কিন ম্যাপিং সিস্টেমে প্রস্তুত নেতা, প্রথম দিন থেকেই। যখন জোরেশোরে সাদ্দাম নেমে গেলেন ইরাককে মধ্যপ্রাচ্যের তথা এশিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে, তখন থেকেই তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা। কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি তাঁকে। পৃথিবী দেখেছে কীভাবে পাঁচ লাখ লোক হলো শহীদ, সুড়ঙ্গ থেকে বের করে আনা হলো তাঁকে, কীভাবে ট্রায়াল, কীভাবে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন তাদেরই তৈরি সাদ্দাম। কথা না শুনলে কান মুচড়ে দেব, এই হলো বড়দের রায়।
তাহলে কথা শুনব, না শুনব না? যদি কোমরে জোর না থাকে তাহলে শুনে যেতে হবে। যেদিন জোর হবে, সেদিন ‘না’ বলার সাহস সঞ্চয় করতে হবে। এখানেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারটি জড়িত। বঙ্গবন্ধু যেদিন ওআইসি কনফারেন্সে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নেন, সেদিন বড় ভাইয়েরা অবাক। বললেন, ‘আমাদের একটু জিজ্ঞেস করলেন না?’ বঙ্গবন্ধু তাঁর পছন্দের পাইপটি থেকে একটু ধোঁয়া ছেড়ে বললেন: ‘আমি কি স্বাধীন ও সার্বভৌম নই?’
স্বাধীন ও সার্বভৌমের প্রয়োজন খুঁটি। খুঁটিটি কেউ বলছেন আণবিক বোমা। পেট্রোডলার, সৈন্যসামন্ত কাজে আসে বৈকি, পরে ক্ষমতাধরেরাও খড়কুটোর মতো স্রষ্টার ইঙ্গিতে ভেসে যায়। ধরা যাক, আক্রমণের শিকার হলাম আমরা। কিছুই হবে না। ১৬ কোটি মানুষকে কোনো দিন কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সার্বভৌম স্রষ্টা আমাদের খুঁটি। অথচ দৈবদুর্বিপাক, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধবিগ্রহ, বড়-ছোটর বিভেদ থেকে রক্ষার কবচ যে প্রভু, তাঁকে ভুলে থাকি সর্বমুহূর্তে।
ইউনূসের প্রশ্নটি বাহানা। দুটি মার্কিন কংগ্রেস থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে যাঁর সম্মান মিলেছে, তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার অধিকার স্টেটের আছে, নিশ্চয়ই আছে। প্রশ্নটি গভীরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কারও চোখরাঙানি সহ্য করে না। যারা সমকালীন ইতিহাসের ছাত্র, তাদের কাছে ব্যাপারটি মোটেও সুখকর মনে হচ্ছে না। ছোট দেশের উচিত ব্যাপারটি হূদয়ঙ্গম করা এবং সেই হিসেবে ব্যবস্থা নেওয়া। মিসর, ইরাক, পাকিস্তান—সর্বত্র ওই গানটিই থেমে থেমে বাজছে, ‘যা হবার তা হবে’। শুনতে চাচ্ছি না ওই গান।
২১ মার্চ, ২০১১
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.