মেধাবীরা সংখ্যায় লঘু হয়ে পড়ছেন! by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

সম্প্রতি ভারতের এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশিষ্ট উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আতিউর রহমানকে ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য সোসাইটিটি প্রফেসর আতিউর রহমানকে এ স্বীকৃতি দিয়েছে বলে


কর্তৃপক্ষের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ব্যক্তিগতভাবে ড. আতিউর রহমানের জন্যই শুধু নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিআইডিএস তথা বাংলাদেশের জন্যও বিরল সম্মাননা বলে আমরা মনে করি। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব উন্নয়নে এশিয়াটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া প্রতিবছর একজন করে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে এই পদকটি প্রদান করে থাকে, তাতে ২০১১ সালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর প্রফেসর ড. আতিউর রহমানকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে এই পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকার নামগুলোই জানিয়ে দেয় এর গুরুত্ব কতটা ব্যাপক। ইতিপূর্বে যাঁরা এ পদক পেয়েছেন তাঁরা হলেন মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিদেল কাস্ত্রো, ইয়াসির আরাফাত, প্রফেসর অমর্ত্য সেন, শেখ হাসিনা, অং সান সু চি, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, পেরেজ দ্য কুয়েলা প্রমুখ। আগামী ৭ মে কলকাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে অধ্যাপক আতিউর রহমানকে ওই সম্মাননা পদক প্রদান করা হবে। আমরা অধ্যাপক ড. আতিউর রহমানকে এই পদকপ্রাপ্তির জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
প্রফেসর আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে ২০০৯ সালের ২ মে যোগদান করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় নতুন এই দায়িত্ব লাভ করেন। এর আগে প্রায় তিন দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এ গবেষক হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন। তখন থেকেই তাঁর মূল্যবান গবেষণা, লেখালেখি ও মতামতের জন্য তিনি সচেতন মহলের কাছে বেশ পরিচিতি লাভ করেন। একজন মেধাবী, সৃজনশীল ও প্রায়োগিক উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেশে-বিদেশে তাঁর খ্যাতি অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৪০টির মতো গ্রন্থ, শতাধিক গবেষণাপত্র এবং অসংখ্য লেখালেখির এই মানুষটি অর্থনীতির নিরেট তত্ত্বেই বিচরণ করছেন না, বরং সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস দর্শনসহ মানবজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ী অভিজ্ঞানের একজন কুশীলব বিশেষজ্ঞ রূপে নিজেকে বিস্তৃত করছেন, সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে ওপরতলার মানুষের জন্য টেকসই উন্নয়নমূলক কল্যাণবাদী সমাজ গঠনে অর্থনীতি ও রাষ্ট্যব্যবস্থার সব প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করা ও রাখার নীতি-কৌশল উদ্ভাবনে কাজ করছেন। তাঁর গবেষণায় মানবকল্যাণে নানা পথ অনুসন্ধানের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ করা যায়, যেখানে অর্থনীতির তত্ত্বের সঙ্গে রবীন্দ্র চিন্তাসহ বাংলার সমাজ বাস্তবতার অভিজ্ঞতা, লোকজ সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক জীবনধারা ইত্যাদি বড় ধরনের উপাদান হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এখানেই ড. আতিউর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ, অর্থনীতি ও মানব চেতনার বিশেষত্ব দেখা, বোঝা ও উপলব্ধি করার রয়েছে। তিনি প্রথাগত অর্থনীতি জ্ঞানে আবদ্ধ না থেকে অর্থনীতিকে দেশীয় বাস্তবতায় মানবকল্যাণবাদী বিশ্ববীক্ষায় গড়ে তোলার গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন। এশিয়াটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার মতো বিশ্ব পরিসরে মর্যাদাশীল গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারে তাঁকে ভূষিত করা এরই স্বীকৃতি হিসেবে মানতে হবে।
আর কিছুদিন পরই গর্ভনর হিসেবে অধ্যাপক আতিউর রহমানের কার্যকাল তিন বছর পূর্ণ হবে। এই তিন বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে তিনি কতটুকু কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন, সেই প্রশ্নটি এ প্রসঙ্গে আসা খুবই স্বাভাবিক। খুব সংক্ষেপে এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে তাঁর গৃহীত উদ্যোগগুলো একনজরে দেখা যেতে পারে। বলে নেওয়া ভালো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, ইউরোপীয় ঋণ সংকট, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে মন্দাজনিত কারণে পড়ন্ত প্রবৃদ্ধির খবর কারো কাছে মোটেই অজানা বিষয় নয়। বিশ্ব অর্থনীতির এমন প্রতিকূল অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে ব্যাংকগুলোকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা এই সময়ে খুব সহজ কাজ ছিল না। গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান কার্যক্রমকে বিশ্ব এবং বাংলাদেশ অর্থনীতির বাস্তবতায় গতিশীল রাখার উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেন। ড. আতিউর রহমান তাঁর দীর্ঘ উন্নয়ন অর্থনীতির গবেষণার অভিজ্ঞতাটি কাজে লাগাতে মোটেও ভুলে যাননি। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের একাত্ম করা এবং কৃষি অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে কৃষকদের ঋণসুবিধা দানের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় ৯৬ লাখ কৃষকের জন্য ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগটি একেবারেই নতুন এবং উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল। এটিকে বিপ্লবাত্মক কাজ বলেই চিহ্নিত করা যায়। এর মাধ্যমে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে নতুন করে প্রাণ ও উৎপাদনশীলতা সৃষ্টির সুযোগ করে দেওয়া হলো। বাংলাদেশ ব্যাংককে ডিজিটালাইজেশন করার ই-টেন্ডারিং, ই-রিক্রুটমেন্ট, অনলাইন ব্যাংকিং, নেটওয়ার্কিং, এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স, ইন্টারনেট সিস্টেম গ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া গ্রাহকসেবার মানোন্নয়নে আমানত ও ঋণের সুদের হার এবং শিডিউল অবসার্জেস-এর পুনঃ তালিকা জনগণের যাতে দৃষ্টিগোচর হয় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখণ যেকোনো গ্রাহক দেশের যেকোনো ব্যাংকের হয়রানিমূলক যেকোনো কাজের প্রতিকার চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে তা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও শাখা অফিসগুলোতে 'গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র' স্থাপন করা হয়েছে। যেকোনো গ্রাহক এর সহযোগিতা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে হয়রানির প্রতিকার পেতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক এই সময়ে অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস গড়ে তোলার ফলে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং, সভরন ক্রেডিট রেটিং, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের বিধিবিধান আধুনিকায়ন, সিআইবি অনলাইন কর্মসূচি, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা, আইপিএফ প্রকল্প, পরিবেশবান্ধব পুনঃ অর্থায়ন স্কিম, এসইসি ঋণ নীতিমালা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ গভর্নর অধ্যাপক আতিউর রহমানের অগ্রসর ও সৃজনশীল চিন্তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত কর্মতৎপরতায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ছয় মাসে মুদ্রানীতির প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার নিয়ম চালু করেছে। ফলে মূল্য স্থিতিশীল রাখা, সাম্য-সহায়ক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও সামগ্রিকভাবে আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রবল মন্দা ও সুনামির তাণ্ডবকালেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সব অভিঘাত থেকে রক্ষা করার কৌশল প্রয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা দারুণভাবে কাজে লেগেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সুস্থ ও বর্ধিষ্ণু ধারাতে রয়েছে, রেমিট্যান্সের প্রাপ্তি তিন বছরে আগের তুলনায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের রপ্তানির প্রবৃদ্ধিও গত তিন বছরে তিন গুণ বেড়েছে। দেশের মুদ্রার রিজার্ভ এ সময়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংযত ও সংহত মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। এসব কাজকর্মের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক দলিলপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। আসলে মেধাবী, সৎ, যোগ্য ও সৃজনশীল মানুষের অভাবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়েছে, এখানে নিন্দুকের মোটেও অভাব নেই, মেধাবীরা তাই সংখ্যায় লঘু হয়ে পড়েছে। এ চিত্র অবশ্যই উদ্বেগজনক।

লেখক : ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.