সমকালীন প্রসঙ্গ-সংঘাতে নয়, সংলাপেই সমাধান by আবু সাঈদ খান

সরকার যদি ভেবে থাকে, বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করবে, তবে তা দেশকে সংঘাতের পথেই ঠেলে দেবে। গায়ের জোরে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হলেও তা অর্থবহ হবে না। খালেদা জিয়ার ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের যে পরিণতি হয়েছে, এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।


বলা বাহুল্য, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতৈক্য ও সমঝোতাই সৃষ্ট সংকট থেকে জাতিকে বাঁচাতে পারে, হরতাল বা দমন-পীড়ন_ কোনো পথেই সমাধান আসবে না


পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সংস্কৃতি আমাদের থেকে পৃথক। সেখানে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তিকে সাধারণত নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুমের শিকার হতে হয় না। এমনকি কোনো দাগি আসামি নির্যাতিত হলেও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মানবাধিকার সংগঠন, সচেতন জনগোষ্ঠী জানতে চায়, এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কি-না। যুক্তরাষ্ট্রে নির্যাতনের মাধ্যমে দাগি অপরাধীদের মুখ থেকে তথ্য বের করার পদ্ধতি নিয়ে সম্প্রতি তুমুল বিতর্ক উঠেছে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। এখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচার-বহির্ভূত হত্যার অভিযোগ দেদার, ক্ষেত্রবিশেষে এমন কাজে হাততালিও মেলে। কত সাধারণ মানুষ যে সবার অজান্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিপীড়ত হয়, তার খবর কে রাখে?
কোনো সাধারণ মানুষ নয়, ছিনতাইকারী বা পলাতক কোনো আসামিও নয়, সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ প্রকাশ্য দিবালোকে সংসদ ভবনের সামনের রাজপথে লাঠিপেটা করেছে। পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, লাথি ও ঘুষিতে তার দেহ থেঁতলে গেছে। একপর্যায়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন তিনি। এ দৃশ্য আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি। ঘটনার শুরুতে 'ঘুষি মেরে তোর দাঁত ফেলে দেব'_ জনৈক পুলিশ কর্মকর্তার উক্তিও শুনেছি। ফারুক উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, সাহস থাকলে ফেল। তারপর পুলিশের সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা দেখেছি। পুলিশের ধস্তাধস্তিতে তার গায়ের টি-শার্ট খুলে যায়। মাথা বেয়ে রক্ত পড়তে থাকে, কিন্তু লাঠিপেটা থামে না। ফারুক দৌড়ে ন্যাম ভবনের দিকে ছুটে যান। সেখানেও পুলিশ কর্মকর্তারা পিছু ধাওয়া করে দ্বিতীয় দফা লাঠিপেটা করে। তাকে ভ্যানে তুলতে চেষ্টা করা হয়। সহযোগী সাংসদরা বাধা দিলে এ সময় টানাটানিতে তিনি ভ্যান থেকে পড়ে যান। পুলিশের অভিযোগ, সংসদ এলাকায় মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ, সেখানে ফারুকসহ বিরোধীদলীয় সাংসদরা মিছিল করছিলেন। পুলিশের নিষেধ তারা শোনেননি। বরং উল্টো পুলিশকে তুই-তুকারি করে কথা বলেছেন। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তিনি একটি বাসে ঢিল ছুড়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা বাধা দিলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। আর তারা ফারুক সাহেবকে মারেননি। তিনি পড়ে গিয়ে আহত হয়েছেন। তবে দেশের জনগণ টিভির পর্দায় যা দেখেছে, তা কি মিথ্যা?
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, সংসদে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ সত্য, তার পরও সাংসদদের মিছিল হয়, সমাবেশ হয়, পাল্টাপাল্টি স্লোগান হয়। এমন ঘটনা দুনিয়ার অনেক সংসদে, এমনকি বাংলাদেশেও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সতর্ক থাকে। সংঘর্ষ হলে প্রতিহত করে। কিন্তু মিছিলের ওপর চড়াও হয় না। ওই দিন বাইরের কোনো মিছিল সংসদ এলাকায় প্রবেশ করেনি। মিছিল হলেও সেটি ছিল সাংসদদের মিছিল। সঙ্গত কারণেই গুটিকয় সাংসদের এ মিছিলে বাধা দেওয়া উচিত হয়নি পুলিশের। এ শিক্ষা ও জ্ঞান পুলিশের থাকা বাঞ্ছনীয়।
যদি ফারুক তুই-তুকারি করে থাকেন, সেটি অশোভন; বাসে ঢিল ছুড়ে থাকেন, সেটি আইনের লঙ্ঘন। এ কারণে কি পুলিশ তাকে লাঠিপেটা করবে? তিনি ভায়োলেন্ট হয়ে উঠলে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারত। কিন্তু তা না করে যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে, তা কি সমর্থন করা যায়?
৬ জুলাই হরতালের দিন পুলিশের এ নির্মমতার পর প্র্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। পুলিশের বাড়াবাড়ি হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। পুলিশকে দিয়ে পুলিশের তদন্তে কি সত্যের উদ্ঘাটন সম্ভব? স্বয়ং মন্ত্রীরা যখন পুলিশের সাফাই গাইছেন এবং জয়নুল আবদিন ফারুকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন, তখন পুলিশই বা কতটা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে?
ক্ষমতাসীন দলের সাংসদরা বিষয়টি কেবল হালকাভাবে দেখছেন না, ফারুকের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছেন। তাদের বক্তব্য থেকে সন্দেহ হতে পারে, ঘটনাটির পেছনে সরকারের মদদ রয়েছে। অবশ্য এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। আমার মনে আছে, বিএনপির শাসনামলে যখন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে পুলিশ লাঠিপেটা করে ধরাশায়ী করেছিল, তখন বিএনপি নেতাদের মুখে অনুরূপ মন্তব্য শুনেছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির নেতারা, আর বিএনপির শাসনামলে আওয়ামী লীগের নেতারা লাঞ্ছিত হবেন, এটি কি চলতেই থাকবে? আমরা মনে করি, এর অবসান হওয়া দরকার।
কী করে অবসান হবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কথায় মনে হয়, তারা পুলিশের মন্ত্রী। পুলিশের দোষ ঢাকতেই ব্যস্ত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহত পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আসলে তারা আহত কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে দেখতে যাওয়া কি তার কর্তব্যে পড়ে না? সে কথা থাক, সংসদের যিনি অভিভাবক, স্পিকার_ তিনিও আহত সাংসদকে দেখতে গেলেন না? সচেতন বুদ্ধিজীবী মানবাধিকারকর্মীরাও এ ঘটনার প্রতিবাদ জানাননি। সবাই কি ধরে নিয়েছেন, বিএনপির সাংসদ মার খেয়েছেন, প্রতিবাদ বিএনপি করবে, আমরা কেন?
দলবাজি সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করেছে, আমরা আজ দলের ঊধর্ে্ব উঠে ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলছি না, প্রতিবাদ করছি না। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে, পুলিশ প্রশাসনেও বিভক্তি রয়েছে। কেউ স্বীকার করুন আর না-ই করুন, প্রশাসন ও পুলিশ আজ আওয়ামীপন্থি ও বিএনপিপন্থি দুই শাখায় ভাগ হয়ে পড়েছে। বিএনপির শাসনামলে রাজধানীর থানাসহ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিএনপিপন্থিদের পোস্টিং ছিল, এখন আওয়ামীপন্থিদের বসানো হয়েছে। যে দুই পুলিশ কর্মকর্তা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে লাঞ্ছিত করলেন, তারা আওয়ামী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার। ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডারদের পুলিশ হতে বাধা নেই। তবে তাদের দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেবাধর্মকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু তা কি সম্ভব? ক্ষমতাসীন দলই যখন তাদের অন্যায়-অপকর্মের সমর্থন দিচ্ছে, বিরোধীদের দমনের জন্য ব্যবহার করছে, তখন তাদের মধ্যে সেবার মানসিকতা কীভাবে আসবে?
প্রশ্ন হচ্ছে, এই দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে সরকার কতটুকু লাভবান হয়? আসলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করতে হয়। বল প্রয়োগের ফলে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে।
এ কথার অর্থ এই নয় যে, আমি বিরোধী দলের হরতালের রাজনীতি সমর্থন করছি। জনগণ ভোট দিয়ে সাংসদদের নির্বাচিত করেছে সংসদে যাওয়ার জন্য। তারা সংসদে যাবেন, সরকারের কাজের মূল্যায়ন-সমালোচনা করবেন, আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন, জনগণের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলবেন। কোনো যুক্তিতেই তা থেকে বিরত হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অতীতে বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি সংসদ বর্জন ও হরতালের নেতিবাচক রাজনীতি করছে। গত আড়াই বছরে বিরোধী দলের রাজনৈতিক ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রথমে সংসদ কক্ষের প্রথম কাতারে আসনসংখ্যা বাড়ানো, খালেদা জিয়ার বাড়ি রক্ষা, বিরোধীদলীয় নেতার ছেলে তারেক-কোকোর দুর্নীতির মামলাসহ দলীয় নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহারই তাদের মূল দাবি। জনজীবনের সমস্যা-সংকট দাবির তালিকায় জুড়ে দিলেও তা যে আন্দোলনের মূল ইস্যু ছিল না, তা সবার কাছেই স্পষ্ট। সংসদ কক্ষে প্রথম কাতারে আসন বাড়ানোর দাবিতে বাদ-প্রতিবাদ হতে পারে, কিন্তু এ জন্য সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক? খালেদা জিয়ার বাড়ি রক্ষা এবং তারেক-কোকোসহ নেতাকর্মীদের মামলার বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে, এ ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ নিয়ে হরতাল করার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে একটি যৌক্তিক ইস্যু ধরিয়ে দিয়েছে। ইস্যুটি যৌক্তিক হলেও নির্বাচনের এখনও আড়াই বছর বাকি। হরতাল না করে বিরোধী দল ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে পারত। সেটি হতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক।
১৯৯৬ সালে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের শরিকরা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অর্জন করেছে, আজ আদালতের রায়ের বাহানায় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা বিলোপ করা কতটুকু সমর্থনযোগ্য? সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক বলা হলেও বাস্তব কারণে দুই মেয়াদ এ ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে পারে বলে অভিমত দেওয়া হয়েছে। আদালতের চূড়ান্ত ও বিস্তারিত রায়ের আগেই এটি বিলোপ করার পেছনে দেশের সামগ্রিক কল্যাণের চিন্তা কাজ করেছে বলে মনে হয় না। এ সিদ্ধান্ত বিএনপিকে আরও দূরে ঠেলে দিয়েছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আলোচনার সুযোগ এখনও আছে। বিএনপি এগিয়ে এলে তারা বিষয়টি বিবেচনা করবে। ব্যাপারটি এমন, দ্বার ভেজিয়ে খিল মেরে বলা হচ্ছে_ আসুন, এলে দরজা খুলব। এ বক্তব্য আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক নয়। তদুপরি জয়নুল আবদিন ফারুককে লাঞ্ছনার ঘটনা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিল।
সরকার যদি ভেবে থাকে, বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করবে, তবে তা দেশকে সংঘাতের পথেই ঠেলে দেবে। গায়ের জোরে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হলেও তা অর্থবহ হবে না। খালেদা জিয়ার ১৯৯৬ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের যে পরিণতি হয়েছে, এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। বলা বাহুল্য, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতৈক্য ও সমঝোতাই সৃষ্ট সংকট থেকে জাতিকে বাঁচাতে পারে, হরতাল বা দমন-পীড়ন_ কোনো পথেই সমাধান আসবে না।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.