চারদিক-ঝাড়ুয়ার বিল গণহত্যা by তুহিন ওয়াদুদ

আগামীকাল ১৭ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝাড়ুয়ার বিলে এক ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখন রংপুর এবং সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্তিকামী দেশপ্রেমী অনেক সৈনিক এসে আশ্রয়


নিয়েছিলেন রামনাথপুরে। রংপুর থেকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট যেতে মধ্যবর্তী স্থানে যমুনেশ্বরী নদীর অবস্থান। যমুনেশ্বরীর পশ্চিমে মুক্তিবাহিনীর অনেকেই শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে এবং পাকিস্তানিদের সৈয়দপুর যাওয়ার পথ বন্ধ করে রাখে। ২৭ মার্চ থেকে সেখানে কর্নেল আনোয়ারের নেতৃত্বে অধ্যাপক এম শাহনওয়াজ আলী (বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান), সুবেদার শহিদুল হকসহ অনেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ৮ এপ্রিল এক সম্মুখযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়।
পাকিস্তানিরা চারটি কারণে রামনাথপুর আক্রমণ করে। প্রথমত, রংপুর সৈয়দপুরের অনেক মুক্তিকামী সৈনিক সেখানে ছিল, দ্বিতীয়ত, যারা যমুনেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রতিরোধব্যূহ গড়ে তুলেছিল, তারাও অনেকে রামনাথপুরে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে—এ ধারণা তাদের ছিল, তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের নেতা ডাক্তার মনসুর আলীর অবস্থান ছিল সেখানে এবং সৈয়দপুরে বসবাসকারী অনেক বাঙালি এসে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সবাইকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করে রামনাথপুর। ১৫ এপ্রিল তারা সেখানে রামকৃষ্ণপুর মৌজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং চারজনকে হত্যা করে। ১৬ এপ্রিল ধাপপাড়া, মুকসুদপুর এলাকায় বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং ১০ জনকে হত্যা করে। মৃত্যু-আতঙ্কে স্থানীয় মানুষ রামনাথপুরের ঝাড়ুয়ার বিল, পদ্মপুকুর এলাকা নিরাপদ ভেবে সমবেত হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল দুপুর ১২টায় পাকিস্তানিরা পার্বতীপুর থেকে জামায়াতের নেতা বাচ্চু খান, কামরুজ্জামান এবং নঈমকাজীর নেতৃত্বে একটি ট্রেনে এবং রংপুর থেকে অন্য একটি ট্রেনে অনেক পাকিস্তানি আর্মি এসে রামনাথপুর ঘিরে ফেলে। দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে তারা নৃশংসভাবে দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করে।
সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষকারীদের একজন হচ্ছেন মেসের উদ্দিন। তাঁর বয়স এখন ষাটের ওপর। চার দশক আগে প্রত্যক্ষ ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, সেদিনের সে ঘটনা তাঁর স্মৃতিতে আজও ম্লান হয়নি। দগ দগে ক্ষত এখনো তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
১৭ এপ্রিল দুপুরে গুলির শব্দে কম্পিত হতে থাকে ঝাড়ুয়ার বিল। ঝাড়ুয়ার বিলে আশ্রয় নেওয়া মানুষের অধিকাংশই সেখানে শহীদ হন। মেসের উদ্দিন তাঁর বাবার সঙ্গে গর্তে লুকিয়েছিলেন। আক্রমণ শেষে যখন পাকিস্তানিরা চলে যায়, তখন মেসের উদ্দিন তাঁর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজতে থাকেন স্বজনদের লাশ। তিনি খুঁজে পান তাঁর চাচা, চাচি ও ভাইয়ের মৃতদেহ। তাঁর চাচি সন্তানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এই অবস্থায় তাঁর পিঠ এবং বুক ভেদ করলে মা এবং সন্তান একই গুলিতে মারা যান। এই মৃত মা এমন শক্ত করে তাঁর সন্তানকে জড়িয়ে ধরেছিলেন যে মৃত্যুর পর দেহ দুটোকে আলাদা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। মেসের উদ্দিনের কাছে এসব জানতে গিয়েছিলাম আমার এক শিক্ষার্থী রোকনকে সঙ্গে নিয়ে। আমার তরুণ শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে দেখি, তারও চোখ আর্দ্র। পাকিস্তানিরা সেই হত্যাকাণ্ডের পর বেঁচে থাকা অনেককেই ধরে নিয়ে যায় স্টেশনে। একজন বাঙালি নামাজের জন্য আবেদন করেন। সেখানে হিন্দু ও মুসলমান সবাই নামাজ আদায় করেন। একজন পাকিস্তানি আর্মি বলে, ‘হিন্দু আদমি একধার হও, যুবক আদমি একধার হও, স্টুডেন্ট আদমি একধার হও।’ সেখানে যাঁরা বয়সে তরুণ এবং যুবক ছিলেন, এ রকম প্রায় ২০০ মানুষকে তারা ধরে নিয়ে যায়। আর কোনো দিন ফিরে আসেনি তারা। শুধু হাত-পা বাঁধা চার-পাঁচজনের লাশ পাওয়া যায়। যাদের লাশ পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে একজন ছিল মেসের উদ্দিনের খালাতো ভাই সমবারু। সমবারুর মৃত্যুর খবর শোনামাত্র তাঁর স্ত্রী গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মেসের আলী যখন সমবারুর স্ত্রী মর্জিনার মৃতদেহ নিজ হাতে নামানোর কথা বলছিলেন, তখন তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
চার দশক আগের ১৭ এপ্রিল সম্পর্কে মেসের উদ্দিন বলা শেষ করে আক্ষেপে ফেটে পড়েন। প্রায় দেড় হাজার মানুষকে যে স্থানে দুপুর থেকে বিকেলের ব্যবধানে মেরে ফেলে পাকিস্তানিরা, সেখানে এখনো স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠেনি। শুধু তাই নয়, যে ঝাড়ুয়ার বিলের বিভিন্ন স্থানে সেই মৃতদেহগুলো মাটির নিচে রাখা হয়েছিল, সে স্থান থেকে মাটি তুলে ইটভাটার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। ঝাড়ুয়ার বিলের এ গণহত্যা নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দেড় সহস্রাধিক শহীদদের মধ্যে যে নামগুলো পাওয়া গেছে এখানে তাঁদের নামাঙ্কিত একটি মিনার তৈরি করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা যতটা বুলিসর্বস্ব করেছি, ততটা অন্তরে ধারণ করিনি। এ আমাদের দীনতা।
তুহিন ওয়াদুদ

No comments

Powered by Blogger.