সপ্তাহের হালচাল-সেই রাতের নাম না জানা প্রথম শহীদ by আব্দুল কাইয়ুম

সম্ভবত তাঁরাই ছিলেন সেই ২৫ মার্চ রাতের প্রথম দিকের শহীদদের অন্যতম। সম্ভবত বলছি এ জন্য যে সেই রাতে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে যে রকম নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল, তার কোনো শুরু বা শেষ হিসাব করে বলা কঠিন। প্রথম প্রহরেই আক্রান্ত হয়েছিল সারা ঢাকা শহর।


দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক। মাঝ রাতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায়। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও ছাত্রদের কী নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তার বিবরণ আমরা জানি। এর সামান্য আগেই কিন্তু গণহত্যা শুরু হয়ে গিয়েছে। পরিবাগ এলাকায় প্রাণ দিয়েছে কিছু তরুণ। গরিব বস্তিবাসী। এ রকম অসংখ্য নাম না জানা শহীদের কথা স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
সেদিন বিকেলেই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংক নামবে। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র ইউনিয়নের একটি সমাবেশ ছিল। প্রতিদিন বিকেলে এ রকম সমাবেশ হতো। দুপুরে রাজপথে ডামি (কাঠের) রাইফেল নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত অনুশীলন হয়েছে। শত্রুর মোকাবিলার একটা প্রস্তুতি চলছিল। এর মধ্যে খবরটা আসে। আমরা সবাইকে বলি যার যার এলাকায় গিয়ে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে। পরদিনের সমাবেশ বিকেলের পরিবর্তে সকালে হবে বলে আমরা জানিয়ে দিই। ধরে নিয়েছিলাম যে রাতে একটা কিছু ঘটে যাবে। তাই জমায়েত রাখা দরকার। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী যে এমন পৈশাচিক বর্বরতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, আর সেটাই হবে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের শুরু, সেটা আমরা সেই বিকেলে ভাবতে পারি নাই।
৭ মার্চ রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণের পরই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম ছাড়া আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। সাধারণ মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের পাশাপাশি ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কিছু প্রস্তুতি চলছিল। অন্যান্য সংগঠনও যার যার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমরা জানতাম প্রথম সুযোগেই ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আঘাত হানবে। তাই আমরা ছাত্রকর্মীদের সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে না থাকার পরামর্শ দিই।
সন্ধ্যায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ আমরা কয়েকজন হাতিরপুলের দিকে যাই। সেখানে দেখা হয় পঙ্কজ ভট্টাচার্য (সে সময় ন্যাপ, বর্তমানে গণফোরাম নেতা), ওসমান গনিসহ (প্রয়াত সিপিবি নেতা) আরও কয়েকজন নেতার সঙ্গে। আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মিলে স্থানীয়ভাবে কিছু প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিই। যদিও আমরা তখনো বুঝতে পারিনি কী বিভীষিকাময় রাত অপেক্ষা করছে।
হাতিরপুলে যাওয়ার একটা কারণ ছিল। ওই এলাকার কাছেই পাক-মটরকে (বর্তমানে বাংলামটর) কেন্দ্র করে কিছু প্রতিরোধ গড়ে তোলার একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা আমাদের ছিল। সে জন্যই সেখানে যাওয়া। অবশ্য পরে দেখা গেল পাকিস্তানি বাহিনী যে বীভৎস গণহত্যা শুরু করে সে তুলনায় আমাদের প্রস্তুতি ছিল একেবারেই নগণ্য। তাদের নৃশংস রূপটি দেখে আমরা দ্বিগুণ প্রতিরোধস্পৃহা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর চোখের আড়ালে থেকে আমাদের নেতৃত্ব দিতেন প্রয়াত সিপিবি নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ, সাইফ উদ্দিন আহমেদ মানিকসহ সিপিবি-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের মূল নেতৃত্বের সমন্বয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় টিম। মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ প্রমুখ সিপিবি ও ন্যাপ নেতাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে প্রস্তুতি চলছিল।
সে সময় পাক-মটর মোড়ের সামান্য উত্তরে একটা কালভার্ট ছিল। যদি পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা আক্রমণ করতে আসে তাহলে সেই কালভার্টটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকের রাস্তা কেটে ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনীর গতিরোধ করার একটা পরিকল্পনা আমাদের ছিল। সেটা মাথায় রেখে আমরা হাতিরপুলে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এ সময় কিছু তরুণ রাস্তায় সমবেত হয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হানাদার বাহিনীকে রুখতে যার যার পাড়া-মহল্লায় স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
সেন্ট্রাল রোডে ছিল প্রয়াত শিল্পী কামরুল হাসানের বাসা। তিনি এগিয়ে আসেন। হাতিরপুল এলাকায় থাকতেন আওয়ামী লীগ নেতা কালু চৌধুরী। আমরা সবাই মিলে বৈঠকে বসি। ঠিক হয় পরিবাগের মোড়ে রাস্তা কেটে ফেলা হবে, যেন পাঞ্জাবি সেনারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে শেরাটন) ট্যাংক-জিপ নিয়ে যেতে না পারে। কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ার বিস্ফোরক পাওয়া গেল না। তবে আমরা কিছু বোতলে পেট্রল ও শিশার টুকরা ভরে মলোটভ ককটেল বানালাম। হাতিরপুলের এ পাশের রাস্তাটা কেটে ফেলার পরিকল্পনাও হয়।
তখন রাত ১০টা হবে। কয়েকজন তরুণ শাবল নিয়ে পরিবাগের মোড়ে চলে যায়। আরেকটি দল যায় এলিফ্যান্ট রোডের দিকে। তারা রাস্তা কাটা শুরু করে। আমরা কয়েকজন হাতিরপুলের ঠিক মোড়ে একটা চারতলা বাড়ির ছাদে মলোটভ ককটেলগুলো সাজিয়ে রাখতে শুরু করি। আমাদের সেই তারুণ্যে উদ্ভাসিত চোখেমুখে তখন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্যারিকমিউনের ‘স্ট্রিট ফাইটের’ বিপ্লব! আমরা ভাবছি পাঞ্জাবি বাহিনীর ট্যাংক এলে ছাদ থেকে ককটেল ছুড়ে তাদের পরাস্ত করব। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ব!
কিছুক্ষণ পর পরিবাগের দিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। এর পরপরই সেই তরুণেরা, যারা পরিবাগের রাস্তা কাটতে গিয়েছিল, চোখেমুখে ভয় নিয়ে ফিরে আসে। তারা জানায়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যাওয়ার পথে রাস্তা খুঁড়তে দেখে একটি জিপ থেকে সেনারা গুলি করে দুই তরুণকে হত্যা করেছে। একের পর এক ট্যাংক আসছে দেখে ওরা ফিরে এসেছে। এর পরপরই থেমে থেমে মর্টার শেলিংয়ের শব্দ শুনি। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ওপর থেকে ট্রেসার বুলেট ছুড়তে দেখি। হোটেলের বিপরীত পাশের গলিতে ছিল দি পিপল পত্রিকার অফিস। পত্রিকাটি ছয় দফা-এগারো দফার সমর্থনে সোচ্চার ছিল। কামানের কয়েকটি গোলায় পত্রিকা অফিসটি ভস্মীভূত করা হয়। তার পেছনের বস্তিতে আগুন ধরে যায়। কিছু লোক তৎক্ষণাৎ মারা যায়। দূর থেকে ভেসে আসে অজস্র গুলি ও মর্টার শেলিংয়ের শব্দ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান শুরু হয়ে গেছে।
মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকায় নীরবতা নেমে আসে। আমরা কয়েকজন হাতিরপুল মোড়ে আমাদের একজন বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিই। কোলে-পিঠে বাচ্চা নিয়ে বস্তির গরিব মানুষেরা নিঃশব্দে হাতিরপুলের বিভিন্ন বাসায় আশ্রয় নেয়।
এ সময় আমরা বুঝতে পারি যে মলোটভ ককটেলে কিছু হবে না, বরং এসব বিপদ ডেকে আনবে। যে ভবনের ছাদে ওই পেট্রোল বোমাগুলো রাখা হয়েছিল, সে বাসার লোকজনও চিন্তিত। তাদের অনুরোধে সেই ককটেলগুলো নিচে নামিয়ে এক বাসার উঠোনে গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখি। লোকজন রাস্তা থেকে সরে যায়। সবাই মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য ভিন্ন কৌশলে অগ্রসর হতে হবে। বুঝতে পারি আমাদের এত দিনের অনুশীলনের ডামি রাইফেলের পরিবর্তে আসল রাইফেল হাতে নেওয়ার সময় এসেছে।
সারা রাত গোলাগুলি চলতে থাকে। পরের দিন কারফিউ ছিল। বিকেলে একটি ট্যাংক আসে। সেনারা নেমে নির্বিচারে গোলাগুলি করে কয়েকজনকে হত্যা করে। তার পরদিন সকালে কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ উঠিয়ে নিলে আমরা বেরিয়ে পড়ি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হল ঘুরে শহীদ মিনারে যাই। সবখানে লাশ আর লাশ। শুরু হয় আমাদের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.