মুক্তিযুদ্ধ-যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুত শেষ করতে হবে by হাফিজুর রহমান

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে লক্ষণীয়ভাবে ছিল। দলটির নেতারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁদের দায়বদ্ধতার কথা জনগণের সামনে তুলে ধরেন। সবাই উদ্দীপিত হন, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তবে মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের অতুলনীয় গৌরবের বিষয় বলে মনে করে, তারা আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা স্থাপন করেছিল।


শুধু তরুণ সমাজ কেন, পুরো জাতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এককাট্টা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর একাত্তরের ঘাতকদের গাড়িতে যখন জাতীয় পতাকা উঠে গিয়েছিল, তখন ঘৃণা ও লজ্জায় আমরা মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম। সভ্য, বিবেকবান ও দায়বদ্ধ মানুষেরা অব্যক্ত যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছিলেন। উত্তরহীন প্রশ্নেরা ঘুরছিল চারদিকে—এ দেশকে স্বাধীন করার জন্য কি ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন?
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুরো জাতি জানিয়ে দিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বায়ান্ন সালে মাতৃভাষাকে রক্ষার দৃঢ়প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়ে যে চেতনার উন্মেষ, যে চেতনা বাঙালি জাতিকে স্বাধীন দেশ ও স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় দিয়েছে, সে চেতনাই প্রতিফলিত হতে দেখলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জনগণের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই চারদিকে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল। কবে শুরু হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সরকার গঠনের দুই-এক মাসের মধ্যেই বিডিআর জওয়ানদের দ্বারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের পর বিষয়টি থমকে গেল। অনেকের মধ্যে বলাবলি করতে শুনলাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অতিদ্রুত করা না হলে তা আর সম্ভব হবে না। অনেক বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট লিখেই ফেললেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত করা বা বিচারটি যেন না হতে পারে সে জন্যই বিডিআরে এত ভয়াবহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। অবশেষে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আমরা আশ্বস্ত হলাম, স্বস্তি ফিরে এল আমাদের মধ্যে। কেননা ওই দিন মুক্তিযুদ্ধের ৩৯তম বছর পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম আরম্ভ হলো।
একাত্তর সালে যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের জন্য সরকার ওই দিন তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। একই সঙ্গে ১২ সদস্যবিশিষ্ট প্রসিকিউশন বা আইনজীবী প্যানেল ও সাত সদস্যবিশিষ্ট ইনভেস্টিগেশন টিম বা তদন্ত দলের নামও ঘোষণা করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত দলের নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকারি সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ যেমন ছিল, তেমনি তা সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে করেছিল উজ্জীবিত।
কিন্তু যে গতিতে বিচার-প্রক্রিয়াটি চলার কথা, সে গতিতে বিচার চলল না, শ্লথ হয়ে গেল। দেখা দিল হতাশা। শুরু হয়ে গেল কথাবার্তা। সমস্যাটা কোথায়? আইনের মধ্যে কোনো গলদ নেই তো? যে আইন অনুযায়ী বিচার শুরু হয়েছে, তাতে একাত্তরের ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যাবে তো? আন্তর্জাতিক চাপ নেই তো? রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি নেই তো? এ ধরনের নানা প্রশ্ন এখন আবর্তিত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে।
তবে আইনের একজন ছাত্র হিসেবে এটুকু বুঝি, যে আইন অনুযায়ী নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীদের বিচারের কাজ শুরু হয়েছে, সে আইন যথেষ্ট শক্ত, পাকা ও জোরদার। এখন মোটামুটি সবাই জানেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী। সংবিধানের মৌলিক মানবাধিকারের বিধান যেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়। ৪৭(৩) অনুচ্ছেদের সরল মানে হচ্ছে, গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে ফৌজদারিতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করার বিধানসংবলিত কোনো আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোনো বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য বা তার পরিপন্থী, এ জন্য বাতিল বা বেআইনি হবে না। অর্থাৎ নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীদের কারাগারে আটকে রেখে বিচারপর্ব শেষে কঠোর দণ্ডদানের পুরো প্রক্রিয়ার কোনো কিছু সংবিধানের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও তা বাতিল বা বেআইনি হবে না। কেননা, উল্লিখিত ব্যক্তিরা গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব অপরাধের বিচার কখনো সময় দ্বারা তামাদি হয় না। সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) ১৯৭৩-এর সম্মিলিত পাঠ থেকে এটুকু বুঝি যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সুষ্ঠু বিচারের মধ্য দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
একশ্রেণীর কলামিস্ট নানা কুযুক্তি ও কূটতর্ক দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। তাঁদের প্রথম কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণার জন্য যে কেউ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩ ধারায় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, তা দেখতে পারেন। এরপর যদি তিনি শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য কারা ছিলেন, তাঁরা সরকারি নথি দেখেন, তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে জামায়াতে ইসলামীর এখনকার নেতৃত্বের অনেকেই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আগেই বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হওয়ায় নানা রকম বিভ্রান্তি, সন্দেহ ও হতাশা তৈরি হচ্ছে। আওয়ামী ঘরানারই অনেকে মনে করছেন, আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত দল আরও বেশি শক্তিশালী হতে পারত। দেশি-বিদেশি আইনের অধ্যাপকদের নিয়ে একটি গবেষণা দল গঠন করতে পারত সরকার। সুশীল সমাজের যেসব ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করতে চান, সে রকম একটি উদ্যোগ ও প্ল্যাটফর্ম গঠন করা যেতে পারত। অনেকেই মনে করেন, ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী দল ও তদন্ত দলকে যে লজিসটিক সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে, তা অপর্যাপ্ত। ওদিকে নিজামী, কাদের মোল্লাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক অভিজাত এলাকায় জায়গা নিয়ে দিন-রাত কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন একদল গবেষণাকর্মী। আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ও অর্থ কোনোটারই কোনো কমতি নেই তাঁদের।
নানা বিভ্রান্তি, সন্দেহ ও সমালোচনা সত্ত্বেও হতাশ নন ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী দল ও তদন্ত দলের সদস্যরা। আইনজীবী দল ও তদন্ত দলের কয়েকজন এবং ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই-একজনের সঙ্গে কথা বলে এমনটা আভাস পেয়েছি। সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে, সব বাধা দূর করে একাত্তর সালে বাঙালির অকুতোভয় সংগ্রাম যেমন করে জয়ী হয়েছিল, তেমনি সব বিভ্রান্তি, সন্দেহ ও হতাশা দূর করে সুষ্ঠু বিচারের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে। এমনটাই প্রত্যাশা রইল।
হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.