যুক্তি তর্ক গল্প-আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দায়িত্ব ঠিকভাবে কি পালন করছে? by আবুল মোমেন

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাধিকার, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠা ছিল মূল লক্ষ্য। একে জোরদার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যের নীতি, এখান থেকে সম্পদ ও অর্থ পাচার এবং সরকারি চাকরি ও সুযোগ-সুবিধায় বঞ্চনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।


বাঙালির এসব অভিজ্ঞতা এবং এ থেকে সৃষ্ট আবেগের ওপর নির্ভর করেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ, যার অন্য দুটো জোরালো অনুষঙ্গ ছিল গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পরে যুক্ত হয় সমাজতন্ত্র।
বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত আমাদের যে রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ঐতিহাসিক অগ্রগতি, তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হয় না, হতে পারে না। আর এই বাঙালির জাগরণে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, পেশাজীবী এবং ছাত্র-জনতা বিশাল ভূমিকা ও অবদান রেখেছিল।
এর সবটাই যেহেতু অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই প্রণোদনা জুগিয়েছে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে এ চেতনাই মূলত কাজ করেছে, তাই কোনো রাজনীতি এর বিপরীতে কাজ করলে তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে সচেতন মানুষ।
আমাদের দেশের দুই বড় দলের রাজনীতি এই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যখন বিচার্য হয়, তখন শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ অনেক বিবেচনা-সমালোচনার পরও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই মতাদর্শের প্রতি সমর্থকগোষ্ঠী তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আজ একাত্তর-বাহাত্তরের মতো অকুণ্ঠ সমর্থন আওয়ামী লীগকে দিচ্ছে না। তারা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছে। অন্যদিকে বিএনপি বায়ান্ন-একাত্তরের রাজনীতির বিষয়ে উদাসীন থেকে, পঁচাত্তরের হত্যাকারী বা একাত্তরের ঘাতক-দালালদের প্রতি অনুকূল থেকেও যথেষ্ট সমর্থন ভোগ করছে।
এটা এ রাজনীতির অর্জন যেমন, তেমনি বিপরীতে অন্য রাজনীতি বা আওয়ামী লীগের অবক্ষয়ও প্রমাণ করে। সে বিষয়টা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছে কি না সেটা বোঝা যায় না। অনেকেরই ধারণা, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মনে করে বায়ান্ন-একাত্তরের তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় যারা বিশ্বাসী, তাদের পক্ষে বিএনপিকে সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয় এবং দেশেও যখন অন্য কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি নেই, তাই তাদের আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
ইতিমধ্যে দেশের রাজনীতির ব্যাপক অধঃপতন হয়েছে, তার দায় যেমন আওয়ামী লীগকে কিছু নিতেই হবে, তেমনি তার ফলাফলও ভোগ করতে হবে। এর মধ্যে রাজনীতির মাঠ থেকে আদর্শবাদী প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন আর উত্থান ঘটেছে যেকোনোভাবে বিত্তবান হওয়া ভুঁইফোড় রাজনীতিকের। নির্বাচনে বিজয় অর্জনে টাকা, ক্ষমতার প্রভাব, এমনকি জবরদস্তি চালানোর ক্ষমতা প্রয়োজনীয় বলে গণ্য করেন তাঁরা।
অন্যদিকে, সময়ের নিয়মে ও প্রভাবে আওয়ামী লীগের কর্মী-নেতাদের মধ্যেও জবরদস্তি করা, বিত্ত অর্জন আর ক্ষমতার প্রতিপত্তি খাটানোর প্রবণতা বেপরোয়াভাবে বেড়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের অপরাধ কিংবা রাজনীতিবিরোধী আচরণকে দলের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে, সয়ে নিয়ে ধারণ করে চলেছে। যাঁর বা যাঁদের মূল লক্ষ্য ক্ষমতা ও বিত্ত অর্জন, তাঁদের কাছে ইতিহাস কিংবা ভবিষ্যৎ, দেশ কিংবা জাতির স্বার্থ, দল কিংবা মানুষের কল্যাণ ইত্যাদি মূল বিচার্য বিষয় আর থাকে না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজনীতিতে দুই বড় দলের কল্যাণে এদের সংখ্যা ও প্রতিপত্তিই বেড়ে চলেছে।
অনেকের মনেই আজ এ রকম ভাবনা-দুর্ভাবনা কাজ করছে যে গত ২৫-৩০ বছরে আওয়ামী লীগে এমন মানুষেরা নানা পর্যায়ের নেতা হিসেবে সংখ্যায় বেড়েছেন, যাঁদের কাছে ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ইত্যাদি নিছক মুখের কথায় তথা লোকভুলানো কথায় পর্যবসিত হয়েছে। এ নিয়ে দারুণ হতাশা যেমন আছে, তেমনি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পথ কী হবে, তা নিয়ে মনে সংশয় জাগে।
যখন দেখা যায়, আওয়ামী লীগেও বিএনপির মতোই সভানেত্রীর একক সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বই কায়েম হয়েছে, দলের অভ্যন্তরে কোনো রকম গণতন্ত্র নেই, যখন মানুষ দেখে টেন্ডারবাজি-দখলদারিতে আওয়ামী কর্মীরা কোনো অংশে কম নন, যখন তারা দেখে ব্যক্তি গোষ্ঠী স্বার্থে অন্তর্দলীয় কোন্দলে দলটি জর্জরিত, তখন বায়ান্ন-একাত্তরের চেতনার মানুষটি এ দলটিকে চিনতে পারে না। অকুণ্ঠ নিঃশর্ত সমর্থন তো দিতেই পারে না। ভুলে বসলে চলবে না যে মানুষের সমর্থন নিঃশর্তও নয়, নিঃস্বার্থও নয়।
এর সঙ্গে যদি বিদ্যুৎ-সংকট, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য, কর্মসংস্থানসহ অপরাধ ইত্যাদি সমস্যার কথা টানি তখন দেখা যাবে এসব ক্ষেত্রে আজ আওয়ামী লীগ-বিএনপিতে পার্থক্য নেই। এমনকি প্রশাসনিক দক্ষতা, নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারে দক্ষতা, সংসদের কার্যকরতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিলেও মানুষ বড় দুই দলে পার্থক্য করতে পারে না।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে দুবার ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগের দক্ষতা, সততা, আন্তরিকতা ও অঙ্গীকারের জায়গাগুলো নিয়ে ভাবছে না। শিক্ষা, কৃষি, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু সাফল্য এলেও দুর্নীতি, বাজারদর, বেকারত্ব, অপরাধ এবং দলীয় ক্যাডারদের বাড়াবাড়ির কারণে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ অস্বস্তি কিন্তু বেড়েছে।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ যদি কেবল মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আর একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারকেন্দ্রিক ভাবাবেগের রাজনীতির ওপরই ভরসা করে বসে থাকেন, তাহলে হয়তো নির্বাচনে অভীষ্ট ফলাফল নাও পেতে পারেন। তুলনায় এই একটি ক্ষেত্র ব্যতীত রাজনৈতিক অঙ্গনের বাকি প্রায় সব ইস্যুতে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর আওয়ামীবিরোধী রাজনীতি নিয়ে সরব হওয়ার ও মাঠ দাপানোর সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
ক্ষমতায় থেকে এ ধরনের আন্দোলনকে মাঠ পর্যায়ে মোকাবিলার যে নীতি আওয়ামী লীগের দল ও সরকার নিতে চলেছে, তা কিন্তু সহজ হবে না। প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি পুলিশি অ্যাকশন, প্রতিটি ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে সম্পদ ধ্বংস, যা আমাদের দেশে এ ধরনের জঙ্গি আন্দোলনের অনুষঙ্গ—তার দায় এসে পড়বে সরকারের ওপর। আর তখন সরকারি শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিরোধীরা যে ভাবাবেগের রাজনীতি চালু করতে পারবে তার সাময়িক মূল্য একাত্তর-মুক্তিযুদ্ধের ভাবাবেগের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হতে পারে। অর্থাৎ, এ রকম রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে, সাময়িকভাবে হলেও চিরায়ত চেতনা ও মূল্যবোধকে ছাপিয়ে চলমান ইস্যুকেন্দ্রিক তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ লাভবান হতে পারে। আর তার প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে।
এটা এখন বুঝতে হবে আওয়ামী লীগকে, যে চেতনা ও আদর্শের ভাবাবেগ নিয়ে বিপুল গণসমর্থন পাওয়া যায়, তা চলমান সমকালীন বাস্তব ইস্যুগুলোর অপূর্ণতা পূরণ করে দিতে পারে না। এ কথা মানতেই হবে, শেষ পর্যন্ত তো কোনো মানুষের পক্ষে বর্তমানের আশু চাহিদা উপেক্ষা করার উপায় থাকে না, নিজের সংসার-সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্ত শান্তিপূর্ণ বর্ধিষ্ণু জীবনই তার কাম্য। বারবার ইতিহাস ও আদর্শের কথা বলে তাদের সহানুভূতি সমর্থন একই মাত্রায় আদায় করা মুশকিল।
বরং ভয় হলো, স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের আশা জাগিয়ে ভোট আদায় করে সরকার গঠনের পর বারবার ব্যর্থ হতে থাকলে, কিংবা দেশ পরিচালনায় বিপক্ষের অনুসৃত পথেই চলতে থাকলে, মানুষ স্থায়ীভাবে হতাশ হতে পারে। এমনকি রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের বুলির বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাবে। সেটা দেশের রাজনীতির জন্য ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনবে।
তা ছাড়া বিএনপিরও তো একটি চেষ্টা থাকবে তার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, বায়ান্ন-একাত্তরের অর্জনের প্রতি উদাসীন দলের ভাবমূর্তি কাটানোর। সে কাজ তারা জোরেশোরেই চালাচ্ছে। ফলে এ দল সম্পর্কে অনেকের মনের অনীহাও কাটতে শুরু করবে।
বিএনপি যদি সাহস করে জামায়াত, জঙ্গি ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ও তাদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। এখন প্রশ্ন হলো, বিএনপি এই পথে চলবে কি না। আর আওয়ামী লীগ দল ও সরকার হিসেবে আন্তরিকতা, অঙ্গীকার, দক্ষতা, গণতান্ত্রিক ঔদার্য্য-সহনশীলতা, সংসদ ও স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করা এবং সবার জন্য দেশের কাজে হাত লাগানোর সুযোগ তৈরি করবে কি না, সেটার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে দেশের রাজনীতিতে ভবিষ্যতে সত্যিই গুণগত পরিবর্তন আসবে কি না। বিষয়টি দুই দলের রাজনীতিকেরা গভীরভাবে ভাবলে ভালো হয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.