মুক্তির সংগ্রাম -সিরাজ নেতাজী মুজিব ত্রিভুজ by অমিত বসু

মুজিবের অপ্রতিরোধ্য তেজের উদ্ভব আকস্মিক নয়। আদর্শের উৎস সিরাজউদদৌলা, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিততে পারেননি। বিশ্বাসঘাতকতায় নিঃশেষ। মুজিবের জীবনেও সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। সামরিক জয়ের পর স্বজনদের বেইমানিতে নিশ্চিহ্ন। সামরিক শক্তির পুনরুত্থান। ওপর-নিচে আর্থিক ফারাক বিস্তর। মূল্যবোধ মূল্যহীন।


মুজিব এই বাংলাদেশ চাননি। উদার বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে, সমাজতন্ত্রের নিশান ওড়াতে চেয়েছিলেন। এত সব ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি সফল। আর কিছু না হোক সিরাজের স্বপ্ন সফল করেছেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আমবাগানে স্বাধীনতার শেষ সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেটাকে তিনি ফের টেনে তুলেছেন। অসীম বীরত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। বাকি দায়িত্বের উত্তরাধিকার নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে এখানেই মুজিবের অন্তহীন মিল

মাটি ফুঁড়ে ওঠে সবুজ গাছের ডালটা তিনতলার জানালায় টোকা দিচ্ছে। ঝড় সাহস জোগাচ্ছে। মধ্যরাতের অত্যাচার। রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড স্তব্ধ। দু'পাশের সব বাড়ি ঘুমন্ত। জেগে আছে বেকার হোস্টেলের লাল আবাসন। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমলিন স্মৃতি। অতীত, বর্তমানকে ধরে আছে অন্তহীন আকর্ষণে। উত্তর-পূর্ব কোণের ২৩ নম্বর ঘরটা নীরব। ইসলামিয়া কলেজের আবাসিক ছাত্র মুজিব উজ্জ্বল ইতিহাস রেখে অদৃশ্য। বাঙালিকে জাগাতে চেয়েছিলেন, জাগিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সত্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি গড়তে চেয়েছিলেন, পারেননি। পারতে দেওয়া হয়নি। নির্মম আঘাতে স্বপ্ন শেষ। উন্মুক্ত, উদার, উজ্জ্বল বাঙালি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়নি। অন্ধকারে রুদ্ধ হয়েছে বিশ্বজনীন মানবসত্তা। যেটুকু পেরেছেন তাওবা কম কী? পৃথিবীর বুকে মাথা তুলেছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালির নিজের দেশ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আ মরি বাংলাভাষাকে ঘিরেই তো মুক্তিযুদ্ধ। প্রাণ দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষার মন্ত্র শিখিয়েছেন পৃথিবীকে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই ভাষাশহীদ স্মরণে শুধু বাংলা নয়, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস।
মুজিবের অপ্রতিরোধ্য তেজের উদ্ভব আকস্মিক নয়। আদর্শের উৎস সিরাজউদদৌলা, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিততে পারেননি। বিশ্বাসঘাতকতায় নিঃশেষ। মুজিবের জীবনেও সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। সামরিক জয়ের পর স্বজনদের বেইমানিতে নিশ্চিহ্ন। সামরিক শক্তির পুনরুত্থান। ওপর-নিচে আর্থিক ফারাক বিস্তর। মূল্যবোধ মূল্যহীন। মুজিব এই বাংলাদেশ চাননি। উদার বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে, সমাজতন্ত্রের নিশান ওড়াতে চেয়েছিলেন। এত সব ব্যর্থতার মধ্যেও তিনি সফল। আর কিছু না হোক সিরাজের স্বপ্ন সফল করেছেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আমবাগানে স্বাধীনতার শেষ সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেটাকে তিনি ফের টেনে তুলেছেন। অসীম বীরত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। বাকি দায়িত্বের উত্তরাধিকার নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে এখানেই মুজিবের অন্তহীন মিল। নেতাজীরও রাজনৈতিক জীবনের প্রেরণা সিরাজউদদৌলা। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরও কোণঠাসা সুভাষ। মহাত্মা গান্ধীর অনুসারীরা তার বিরুদ্ধাচরণে সরব। রবীন্দ্রনাথ তাকে সাহস জুগিয়েছেন তবু পেরে ওঠেননি, পদত্যাগ করে নিষ্কৃতি পেয়েছেন। সেই সময় চূড়ান্ত নিঃসঙ্গতায় আঁকড়ে ধরেছেন সিরাজউদদৌলাকে। সিরাজবিরোধী ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঝড় তুলেছেন। ছাত্রনেতা মুজিবও তখন সেই সংগ্রামের শরিক। সুভাষ যখন ঢাকায় বিশাল জনসভায় জ্বালাময়ী ভাষণে জনমত গঠনে ব্যস্ত, কলকাতার রাস্তায় তখন মুজিবের নেতৃত্বে মিছিলের প্লাবন। তার সঙ্গীবন্ধু কবি গোলাম কুদ্দুস। ইসলামিয়া কলেজ অর্থাৎ এখনকার আবুল কালাম আজাদ কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে ওয়েলেসলি ধরে মুজিব পেঁৗছলেন ধর্মতলা স্ট্রিটে। উল্টোদিকের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গোলাম কুদ্দুস এসে মিলতেন সেখানে। তারপর দুটি মিছিল এক হয়ে রওনা হতো তখনকার মনুমেন্ট, এখনকার শহীদ মিনারের উদ্দেশে।
সিরাজকে কবর থেকে তুলে এনেছিলেন ইংরেজরাই। প্রায় দেড়শ' বছর আগে সিরাজের কাছে গভর্নর হলওয়েলের আত্মসমর্পণের অপমান তারা ভুলতে পারেনি। মহাকরণের সামনে হলওয়েলের স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করেন লর্ড কার্জন ১৯০২-এ। পরাজিতকে জিতিয়ে দেওয়ার নবতম কৌশলের বিরুদ্ধে তখন কেউ কোনো কথাও বলেননি। ৩৮ বছর পর গর্জে ওঠেন নেতাজী। সঙ্গী মুজিব। পাল্টা আক্রমণে সিরাজের চরিত্র হননে ব্যস্ত হন ইংরেজ ইতিহাসবিদরা। তারা সিরাজকে খলনায়কে পরিণত করতে চেষ্টা করেন। তাদের অভিযোগ ছিল, 'অন্ধকূপ হত্যা' করে সিরাজ চরম নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৮ ফুট লম্বা, ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি চওড়া ঘরে ১৪৬ জন ইউরোপীয় সৈন্যকে আটকে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন সিরাজ। এতে শ্বাসরোধে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। ভারতীয় ইতিহাসবিদরা এটা মানেননি। অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র মজুমদার জানান, ইংরেজরা তথ্য বিকৃত করেছে। যে ঘরটির কথা বলা হচ্ছে সেখানে ৬৫ জনের বেশি রাখা সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত যে ২১ জন বেঁচেছিল সে কথা ঠিক। কতজন মরেছিল বলা শক্ত।
সিরাজ বাংলার নবাব হওয়ার পরই ইংরেজদের ষড়যন্ত্র শুরু। তাদের প্ররোচনায় সিরাজের পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি। ১৯৫৬ সালের ১৬ মে সিরাজ শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ২০ মে রাজমহলে পেঁৗছে জানতে পারেন, কলকাতায় তার পাঠানো দূতকে গুপ্তচর মনে করে তাড়িয়ে দিয়েছে ইংরেজরা। ক্ষুব্ধ সিরাজ ৫ জুন কলকাতা আক্রমণে রওনা হন। পেঁৗছান ১৬ জুন। ২০ জুন কলকাতার নতুন গভর্নর হলওয়েল আত্মসমর্পণ করেন। অপমানের জ্বালা জুড়োতে ক্লাইভের নেতৃত্বে একদল সৈন্য, ওয়াটসনের প্রতিনিধিত্বে বিশেষ নৌবহরকে কলকাতায় আনা হয়। সিরাজের কর্মচারী মানিকচাঁদ সে সময় কলকাতার শাসনকর্তা। ১৭৫৭'র ২ জানুয়ারি বিনাযুদ্ধে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করে। ৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজের সঙ্গে সন্ধি ইংরেজদের। ১৯ মে মীরজাফর-জগৎশেঠ ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হন। বাংলার স্বাধীনতার সূর্য লজ্জায় মুখ লুকোয়। ১৯৬৫তে ইংরেজরা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গঠন করে। ১৭৭০-এ বাংলায় ঘটে মন্বন্তর। ১৭৭২-এ কলকাতা, ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়। ১৯১১তে রাজধানী কলকাতা থেকে দিলি্লতে স্থানান্তরিত হয়। বিষাদেও আনন্দ সংবাদ ছিল একটাই, বাংলাকে ভাগ করাটা যে অন্যায় মেনে নেয় ইংরেজরা। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
এত কিছুর পরও ইংরেজরা কিন্তু সিরাজের কাছে হলওয়েলের মাথানত করার বিষয়টি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। ১৭৬০-এ তারা মহাকরণের উত্তর-পশ্চিম কোণে হলওয়েল স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় ওয়ারেন হেস্টিংসের আসক্তিতে। তিনি বুঝেছিলেন অন্ধকূপের মিথ্যা গল্প ফেঁদে হলওয়েলকে হিরো বানানোর ষড়যন্ত্র বাঙালি মানবে না। দীর্ঘকাল পর লর্ড কার্জন গভর্নর হয়ে এসে সিরাজের বাংলাকে দু'টুকরো করার চেষ্টা করেন এবং হলওয়েল মনুমেন্ট পুনর্নির্মাণ করান ১৯০২তে। ১৯৪০-এ স্তম্ভটি হটানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন নেতাজী। মুজিব তাতে অংশ নেন। নেতাজীকে বন্দি করা হয়। তাতেও আন্দোলন না থামায় ১৯৪০-এর ২৪ সেপ্টেম্বর মহাকরণের পাশে সেন্ট জন্স্ চার্চ প্রাঙ্গণে নির্বাচিত করা হয় মনুমেন্টটি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেটাই নেতাজী-মুজিবের প্রথম রাজনৈতিক জয়। কলকাতার মাটিতে তাঁদের শেষ যুদ্ধও বলা যেতে পারে। তারপর বৃহত্তর আন্দোলন গড়তে দেশান্তরিত হন নেতাজী ১৯৪১-এ। মুজিবও কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। জন জেফালিয়া হলওয়েলের মনুমেন্টটি এখনও পড়ে আছে চার্চ প্রাঙ্গণে। গায়ে গজিয়েচে অশ্বত্থ চারা। নেতাজী-মুজিবের জয়ের স্মৃতিকে ধরে রাখতেই যেন তার বহু কষ্টে বেঁচে থাকা।

অমিত বসু :ভারতীয় সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.