একাত্তরের এই দিনে-একটি পদের জন্য ভুট্টোর ব্যাকুলতা by আইয়ুব খান

একাত্তরের মার্চে যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত সমগ্র দেশ, ‘যার যা আছে তা-ই নিয়ে’ পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি বাঙালি, তখন এক হাজার ২০০ মাইল দূরে বসে সাবেক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান কীভাবে সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক কিংবা ভুট্টোর আস্ফাালন—সেসব বিবৃত হয়েছে তাঁর


রোজনামচায়। মাত্র দুই বছর আগে গণ-অভ্যুত্থানে পদচ্যুত, প্রচণ্ড বাঙালিবিদ্বেষী এই শাসক ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদকে অবশ্যম্ভাবী’ বলে মনে করেছিলেন। ক্রেইগ ব্যাক্সটার সম্পাদিত আইয়ুব খানের রোজনামচা ১৯৬৬-১৯৭২ বইয়ের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন এম এ মোমেন

২১ মার্চ ১৯৭১, রোববার
দেখলাম, ভুট্টো ও তাঁর পার্টির লোকজন ঢাকায় পৌঁছেছেন। তাঁর জন্য বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে হয়েছে, কারণ বাঙালিদের চোখে পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার এবং মুজিবুর রহমানের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হওয়ার দায় তাঁরও।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এয়ারপোর্টে ভুট্টোপন্থী স্লোগান দেওয়া হয়েছে এবং দেশকে বিভক্ত না করার জন্য তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই অবাঙালি হবেন, তবে হোটেলে বিরুদ্ধপক্ষীয় বিক্ষোভও হয়েছে—স্পষ্টতই তা মুজিবুর রহমানেরই আয়োজন। করাচির উড়োজাহাজ ধরার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সঙ্গে ভুট্টো এক ঘণ্টা ধরে কথা বলেন, প্রদেশের অবস্থা একান্তে বুঝতে চেষ্টা করেন। তাঁরা ভুট্টোকে একটি ফুলেল বর্ণনা দিতে সক্ষম হননি, এই উৎপাতের সময় অবাঙালিদের সঙ্গে নির্মম আচরণ করা হয়েছে। তাঁরা অবশ্যই প্রাণভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, প্রয়োজন হলে এই বিষয়টি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির রসদই জোগাচ্ছেন তিনি।
ভুট্টোকে ক্যান্টনমেন্টেই রাখার কথা, কিন্তু তাঁর পীড়াপীড়ির কারণে হোটেলে রাখতে হয়েছে। বিষয়টির ওপর তিনি জোরও দিয়েছেন। অন্যটি ছিল, যত সংক্ষিপ্তই হয় হোক মুজিবুর রহমান যেন তাঁর সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট দুটো ব্যাপারেই তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তার পরই ভুট্টো বলেছেন, তিনি পরিতৃপ্ত বোধ করছেন এবং ঢাকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।
এটা খোঁড়া ও শিশুসুলভ অজুহাতের মতো শোনায়। তিনি আসলে যা চেয়েছেন তা হচ্ছে—সাময়িক কোনো সরকার গঠিত হতে হলে তাতে একটি পদ পাওয়ার নিশ্চয়তা এবং পরবর্তী সময় কেন্দ্রীয় সরকার গঠনকালে তাঁর দল যেন মুজিবুর রহমানের কাছে গুরুত্ব পায় তার নিশ্চয়তা। আর তাঁর বাকি সব হুংকার ও লম্ফঝম্প সবই ফাঁপা—পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই বলে বোকা বানানো যে তিনি জাতীয় স্বার্থে ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে একজন চ্যাম্পিয়ন লড়াকু। কেউ একজন আমাকে জানিয়েছেন, গোয়েন্দা সংস্থা ভুট্টোর ওপর আস্থা হারিয়েছে। তাঁরা ভুট্টোকে স্বার্থপর সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি বলে মনে করেন, তবে সাধারণ মানুষ তাঁর প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে। ভুট্টো কয়েক বছর শাসন করার সুযোগ পেলে তাদের মোহ কাটবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে দেশের আর থাকলটা কী? আর আমাদের বুদ্ধিজীবীরা—আমি বলি, তাঁরা কেবল শয়তানি করার ক্ষমতা রাখেন, তাঁদের দিয়ে ভালো কিছু করানোর প্রত্যাশা কেবল স্বপ্নচারিতা।

No comments

Powered by Blogger.