ইতি-নেতি-আজ পিতা কন্যার বিপক্ষে, বোনের বিরুদ্ধে ভাই by মাসুদা ভাট্টি

ধবাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতায় নারীর অবস্থানটি যে কতটা নাজুক, তা প্রমাণ করে দিল ৪ এপ্রিল ডাকা হরতালের ঘটনা। সরকারপক্ষ দাবি করছে কোনো হরতালই হয়নি, কেবল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত মাদ্রাসাছাত্রদের সশস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় বের করে এনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়া।


আর যিনি হরতাল ডেকেছেন, সেই আমিনী সাহেব তো বলেছেনই যে এটাই নাকি আওয়ামী লীগের এই আমলে সবচেয়ে সফল হরতাল। হরতাল সফল কিংবা বিফল সে বিতর্কে না গিয়ে এ কথা বলাই যায় যে এ হরতাল আসলে এই সমাজের পুরুষতান্ত্রিক চেহারাটি ভয়ংকরভাবে উন্মোচন করেছে এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যদের তা পিতা, স্বামী কিংবা ভাই-ই হোক না কেন; পরিবারের নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে কোনো মুক্তমনা পুরুষ চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারবেন না।
মজার ব্যাপার হলো, যেকোনো সরকার এমনকি বিএনপি-জামায়াত সরকারও যখন নারীবিষয়ক কোনো কিছু ঘোষণা করে তখনই একটি পক্ষ ধর্মের দোহাই দিয়ে নেমে যায় তার বিরোধিতা করতে। স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে নারীনীতি ঘোষণার কথা বলা হলেও তৎকালীন মহিলাবিষয়ক মন্ত্রী সেলিমা রহমান নিজে উদ্যোগী হয়ে নারীনীতির বিরোধিতা করেন এবং তা ঘোষণা থেকে বিরত থাকেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী উদ্যোগী হয়ে নারীনীতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। কে না জানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমন অনেক কিছুই করা হয়েছে, যা অনৈতিক, দেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সংবিধানপরিপন্থী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই নীতির বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার মধ্যেও হাজার হাজার মাদ্রাসাছাত্র রাজপথে মিছিল বের করে ও ভাঙচুর চালায়, তাতে জরুরি অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলে জরুরি সরকারের বাহিনীর নির্দয় লাঠিচার্জ আমাদের অসহায়ত্বকে যে কতটা প্রকট করে তুলেছিল, তা সেই সময়ের যেকোনো সুস্থ বিবেককে প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে আসবে।
এর সরল অর্থ দাঁড়ায় যে নারীনীতি, এতে যা-ই থাকুক না কেন, তা যাতে অনুমোদন না হয় সে জন্য তৎপর কেবল ধর্মভিত্তিক দলগুলো নয়; বরং অনেক উদার রাজনীতিক ও তাদের দলও মৌন থেকে কিংবা এই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সহিংস প্রতিবাদের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করছেন আমাদের সামনে। একজন পরিচিত মানুষ ৪ এপ্রিল হরতাল চলাকালে স্পষ্টতই বললেন যে সত্যিই তো আমার স্ত্রীকে যদি আমার সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিতে হয়, তাহলে তিনি সে সম্পত্তি নিয়ে যেকোনো সময় আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন। হাসি পেল ভেবে যে সম্পদের অর্ধেক দিলেই (যদিও নারীনীতিতে এমন কথা কোথাও লেখা নেই) নারীটি তাঁর স্বামীকে ফেলে অন্যত্র চলে যাবেন। সম্পর্কটা আসলে কতটা নাজুক হলে একজন পুরুষ এ রকম কথা ভাবতে পারেন। এই ব্যবসায়ী, নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবা মানুষটিকে কিছু বলে বোঝাতে চাওয়াটা সময়ের অপচয়। এই ভদ্রলোকের দুটি কন্যাসন্তান, তিনি এও জানেন যে প্রচলিত আইনে তাঁর মৃত্যুর পর তার কন্যাসন্তানের চেয়েও নাকি তার ভাইয়ের পুত্রদের অধিকার তার সম্পদের ওপর বেশি। সে কারণে তিনি নারীনীতির একটু প্রশংসাও করলেন, কিন্তু স্ত্রীকে সম্পত্তি দেওয়ার যে তিনি ঘোরবিরোধী সে কথা তিনি রাখঢাক না রেখেই বললেন। আইন বিষয়ে আমার জ্ঞান-বুদ্ধি অনেক কম, সুতরাং তর্কে না যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আশ্চর্য হলাম একজন সম্পদশালী মানুষের চিন্তাভাবনা দেখে। নারীনীতির বিরোধিতাকারীর তালিকায় এ রকম সম্পদশালী পুরুষের সংখ্যা যে অসংখ্য তা বিশ্বাস করতে এমনিতেও কষ্ট হয়নি কখনো, এই ভদ্রলোকের ওই কথার পর তো আরো হলো না।
৪ এপ্রিল টেলিভিশনের পর্দায় পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা কাফনের কাপড় পরা, গলায় কোরআন ঝুলিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসা যুবকদের দেখে একটি প্রশ্ন মাথায় এসেছে। এদের ঘরে যেসব নারী রয়েছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে কী বলেন? তারা কি জানেন যে এই নারীনীতিতে আসলেই তাদের কী দেওয়া হয়েছে? আমি নিশ্চিত যে তাঁরা জানেন না। অপরদিকে এই কাফনের কাপড় আর গলায় কোরআন ঝুলিয়ে রাস্তায় নামা যুবকদেরও বেশির ভাগই হয়তো জানেন না যে নারীনীতিতে আসলেই কী আছে। তাদের এই নীতির ২৩ ধারাটি কেবল শোনানো হয়েছে, যেখানে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে নারীর প্রাপ্য কেমন হবে সে কথা বলা হয়েছে। হরতালপন্থীরা বলছে যে এই ধারাটি আসলে কোরআন এবং সুন্নাহবিরোধী এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে সরকার অন্যায় করেছে। এ বিশ্বাস নিশ্চয়ই বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ারও, নইলে তাঁর দল কেন পরোক্ষে এ হরতালে সমর্থন দিয়েছে? প্রশ্ন হলো, জিয়া বিকল্প কোনো নারীনীতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে পারেননি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দলের দায়িত্ব সেটা নয়, কোনো কিছুর বিরোধিতা করার আগে তার যুক্তি জনগণের সামনে তুলে ধরে তার বিকল্প কিছু জনগণের সামনে হাজির করতে হবে; যাতে জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে আগামী কুড়ি বছরেও এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেখা পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। তবে খালেদা জিয়া যদি নির্বাচনে বিশ্বাস করেন, তাহলে তাঁর ভাবা উচিত ছিল তাঁর দলের নারী সমর্থক ও নারী ভোটারদের কথা। একটি দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক জনগোষ্ঠীর (জনসংখ্যা সমীক্ষায় দেশে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি বলে কেউ কেউ উল্লেখ করে থাকেন) জন্য সরকার একটি নীতিমালা করেছে। কারণ সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও ব্যক্তিমানুষের মানসিকতার কাছে এই গরিষ্ঠসংখ্যক জনগণ অবহেলা, নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার। তাই সামগ্রিক সমাজোন্নয়নের স্বার্থেই তাদের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন এবং রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণও সুনিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নারীনীতি প্রণয়ন করে সরকার কোনো খারাপ কাজ করেছে বলে সুস্থ মাথার কেউ ভাবতে পারেন বলে বিশ্বাস করি না। এই নীতিতে অগ্রহণযোগ্য কিছু রয়েছে বলেও ভাবার অবকাশ নেই। কারণ ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের ভোটব্যাংক আহত করার জন্য দেশের ধর্মবাদী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যায়_এমন কিছু করতে পারে বলেও বিশ্বাস করার কোনোই কারণ নেই।
আলোচ্য এই নীতি এখনো আইনে পরিণত হয়নি, কেবল মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাভ করেছে। কে জানে, এই বিরোধিতার মুখে সরকার এটি আইনে পরিণত করা থেকে পিছু হটে কি না। হটলেও খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। এই সমাজে, এই রাষ্ট্রে, এ ব্যবস্থায় নারী হয়ে জন্মানোর যে পাপ এর শাস্তি একজন নারী জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভোগ করে, তা একজন নারী মাত্রই জানেন। কেবল এই নীতির কারণে রাতারাতি নারীর অবস্থান পরিবর্তন হতো, তা যেমন ভাবার কারণ নেই; তেমনই এই নীতি বাস্তবায়িত না হলে নারীর অবস্থানের কোনো হেরফের হবে_সেটাও সত্য নয়। সমাজের প্রান্তিক নারীদের সংগ্রাম এক, মধ্যবিত্তের আরেক এবং উচ্চবিত্তের সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকারের জন্য লড়ছে, এই যুদ্ধে তার পাশে কে থাকবে না থাকবে সে তোয়াক্কা না করলেও চলবে।
তবে যে কথা দিয়ে নিবন্ধ শুরু করেছিলাম, সে কথা দিয়েই শেষ করি। ধরা যাক, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের খাবার টেবিল। সেখানে বসেছেন স্বামী-স্ত্রী এবং দুটি সন্তান, যার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ঠিক তখন টিভিতে নারীনীতির জন্য হরতালের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে কাফনের কাপড় পরা যুবকদের সংঘর্ষ। এখন এই মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিভূ খাবার টেবিলে বসা মানুষগুলোর কে কোন অবস্থান গ্রহণ করবে, তার ওপরই আসলে নির্ভর করছে এই পরিবারের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক। এখানে বাবা ও ছেলে এবং মা ও মেয়ে দুটি পক্ষ গ্রহণ করবেন, নাকি উভয়েই নিজেদের আধুনিক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করবেন এবং উভয় পক্ষই নিজেদের 'মানুষ' হিসেবে বিবেচনা করে দুটি নয়, একটি পক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করবেন_তার ওপরই আসলে নির্ভর করছে আগামী দিনের সমাজে নারীর অবস্থান। এই খাবার টেবিল যদি এখন গোটা বাংলাদেশে স্থাপন করি এবং সবাই সবাইকে প্রশ্ন করি যে আমার পুত্র এবং আমার কন্যা কেন ভিন্ন হবে, কেন দুজনই 'মানুষ' বিবেচিত হবে না, কেবল তখনই এই সমাজ খানিকটা হলেও আধুনিক রূপ লাভ করবে। এখানে ধর্ম নয়, মানুষ মুখ্য, মানুষের সম্পর্ক মুখ্য, মানুষের অধিকার মুখ্য।

লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com

No comments

Powered by Blogger.