শ্রম আইন ২০০৬-এর সংশোধনীর খসড়া-শিল্প মালিকদের 'সম্মান' রক্ষায় কারাদণ্ড বাদ by আবুল কাশেম

শেষ পর্যন্ত মালিকদের আবদারই পূরণ হতে যাচ্ছে! তাঁদের 'সম্মান' বাঁচাতে শ্রমিকদের বঞ্চনাই মেনে নিতে যাচ্ছে সরকার। কারখানার মোট লাভের শতকরা পাঁচ টাকা শ্রমিক ভোগ করবে- এ কথা যুগ যুগ ধরে আইনে ছিল। কিন্তু ওই টাকা শোষণ করে খেলেও এত দিন মালিকদের শাস্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।


শ্রমিকদের শোষণকারী মালিক যাতে বাধ্য হন মুনাফার ভাগ দিতে, সে জন্য জেলসহ শাস্তির বিধান ছিল শ্রম আইন ২০০৬-এর সংশোধনীর খসড়ায়। কিন্তু মালিকপক্ষের চাপে 'জেল' আর থাকছে না। শ্রমিকদের টাকা পকেটে ভরা মালিকদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি থাকছে মাত্র এক লাখ টাকা জরিমানা! এ ধরনের আইনের মাধ্যমে মালিকদের সুবিধা দিয়ে শ্রমিকদের বঞ্চনার সুযোগ থাকছে বলে মনে করছেন খোদ শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, শ্রমিকের অধিকার হরণ করে যেসব মালিক শ্রমিকের আইনসঙ্গত ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে তাদের জন্য ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে মালিকদের বিভিন্ন পক্ষের চাপে শাস্তি কমিয়ে কমপক্ষে ১৫ দিন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। তবে আইন মন্ত্রণালয় ছাড়পত্র দিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে যে সংশোধিত আইনটির কপি পাঠিয়েছে তাতে কোনো জেল বা কারাদণ্ডের উল্লেখই নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন করা খসড়ায় সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। আর জরিমানার অর্থ পরিশোধে যত দিন দেরি হবে, তার প্রতিদিনের জন্য ১০ হাজার টাকা বাড়তি জরিমানা হিসেবে যোগ হওয়ার বিধানও থাকছে এতে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, 'আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের মুনাফা থেকে ৫ শতাংশ অর্থ যেসব মালিক দেবেন না তাঁদের জন্য জেল বা কারাদণ্ডের বিধান রাখার কথা আইনের খসড়ায় প্রথমে ছিল। পরে দেখা গেল সম্মানিত ব্যবসায়ীদের জেল দেওয়া ঠিক হবে না। তাই কারাদণ্ডের শাস্তি বাদ দিয়ে শুধু জরিমানার বিধান থাকছে।'
এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড় পাওয়ার সুযোগ থাকলে কোনো মালিক শ্রমিক কল্যাণে অর্থ দিতে আগ্রহী হবেন কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, 'জরিমানার অঙ্ক আরো অনেক বেশি হবে।'
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইন মন্ত্রণালয়ের সংশোধন অনুযায়ীই খসড়াটি আজ সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদনের পর জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনে পাঠানো হবে। তবে সংসদ থেকে আইনটি বাছাই কমিটিতে আসবে। শ্রম মন্ত্রণালয় এখন তাকিয়ে আছে ওই বাছাই কমিটির দিকে। কারণ বাছাই কমিটি মনে করলে কারাদণ্ডের বিধান সংযুক্ত করতে পারবে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব কালের কণ্ঠকে জানান, শ্রম আইন অনুযায়ী বছরশেষে কোনো মালিক ১০০ টাকা মুনাফা করলে সেখান থেকে পাঁচ টাকা শ্রমিকদের জন্য ব্যয় করতে বাধ্য। এতদিন মালিকরা তা করেননি, কারণ এ ধারা লঙ্ঘনের জন্য কোনো শাস্তির বিধান ছিল না। এখন সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে যে আইন করা হচ্ছে, এটি হলেও কোনো মালিক শ্রমিককে মুনাফার অংশ দেবে না।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একজন মালিক বছর শেষে হয়তো এক কোটি টাকা মুনাফা করছেন। ৫ শতাংশ হারে সেখান থেকে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে খরচ করার কথা ২০ লাখ টাকা। সংশোধিত আইনে কারাদণ্ডের বিধান না রেখে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলে ওই মালিক শ্রমিক কল্যাণে ২০ লাখ টাকা খরচ করার চেয়ে সরকারের তহবিলে এক লাখ টাকা জরিমানা দেবেন। কারণ এতেও মালিকের পকেটে অতিরিক্ত ১৯ লাখ টাকা থেকে যাবে।
মন্ত্রিসভা বৈঠকের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সারসংক্ষেপে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কোনো কম্পানির নিট মুনাফার ৯৫ শতাংশ মালিকের প্রাপ্য এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ২৩৪ ধারা অনুযায়ী বাকি ৫ শতাংশ কম্পানির ট্রাস্টি বোর্ডের অধীন গঠিত অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে জমা দিতে হয়। সর্বোচ্চ ৯ মাসের মধ্যে ওই ৫ শতাংশের ৮০ ভাগ অর্থ অংশগ্রহণ তহবিল ও বাকি ২০ ভাগ অর্থ কল্যাণ তহবিলে জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০০৯-এর ধারা ৩ (২০০৬ সালের ৪২ নং আইনের প্রতিস্থাপিত ধারা ২৪৩) অনুসারে কল্যাণ তহবিলে জমা করা অর্থের শতকরা ৫০ ভাগ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইনের (২০০৬ সালের ২৫ নং আইন) ধারা ১৪-এর অধীন গঠিত শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে ৪৫ দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে।
মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন কার্যকর করতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ফাউন্ডেশনের কল্যাণ তহবিলে কম্পানির মুনাফার অংশ দেওয়ার জন্য বারবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। বড় বড় কম্পানির ঠিকানা সংগ্রহ করে কম্পানিগুলোর কাছে মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ চেয়ে নোটিশ দেওয়া হলেও কোনো রকম সাড়া দেয়নি মালিকপক্ষ। তাই শাস্তির বিধান রেখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শ্রমিকদের এই অংশে কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব করেছিল। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.