জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি-বহুমাত্রিক শিল্পী হাশেম খান

আজ তিনি পা দিলেন একাত্তরে। দেশের যে শিশুটি আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পা রাখছে, সে পরিচিত হচ্ছে শিল্পী হাশেম খানের নামের সঙ্গে। আজ শিশু চিত্রকলা বাংলাদেশে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। হাশেম খান এ ধারার পথিকৃৎ। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার সেকদি গ্রামে তাঁর জন্ম ১৯৪১ সালে।


তরুণ বয়সে তিনি কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সানি্নধ্য পেয়েছেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চারুকলা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করেছেন। দেশের চারুকলা বিকাশের আন্দোলন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টিতে তিনি নিবেদিতপ্রাণ। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হাশেম খান ছাত্রজীবন থেকেই সক্রিয়। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সবার সঙ্গে তিনিও পায়ে পা মিলিয়েছেন। ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের প্রায় সব পোস্টার, ফেস্টুন, ছবি, প্রচার পুস্তিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিনি। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফার লোগো, পতাকার নকশা, পোস্টার ও অন্যান্য শিল্পকর্ম করেছেন শিল্পী হাশেম খান। ছয় দফা সর্বপ্রথম জনগণের সম্মুখে ঘোষণার জন্য তৎকালীন হোটেল ইডেনের সামনে যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল, তার ব্যাকড্রপে ছয় দফার প্রতীকি নকশা করেছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে ঐতিহাসিক 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন?' শীর্ষক পোস্টারটিও এঁকেছেন শিল্পী হাশেম খান। বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থটির শিল্পমান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৭৩ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শিল্পাচার্য তাঁর প্রিয়ভাজন শিল্পী হাশেম খানকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থের প্রতি পৃষ্ঠার চারদিকজুড়ে রয়েছে নকশা এবং ভেতরে লেখা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তত্ত্বাবধানে প্রধান শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন শিল্পী হাশেম খান। নকশা তৈরি করেছেন জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। লিপিকার ছিলেন আবদুর রউফ। বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক প্রায় ৩০০ ছবির একটি অ্যালবামের তিনি নির্বাহী সম্পাদক। অ্যালবামের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। 'জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু গ্রন্থমালা'র সম্পাদকীয় বোর্ডের তিনি সভাপতি। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তিনটি অ্যালবামের তিনি যুগ্ম সম্পাদক তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। ঢাকা নগর জাদুঘরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের অন্যতম সদস্য। তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান ছিলেন। দেশ-বিদেশে তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে। শিল্পকর্মে বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়া তিনি দেশি এবং আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৫টি। শিল্পীরা হলেন সেই চেতনাঋদ্ধ মানুষ, যাঁরা আঁধারেও স্বপ্ন দেখেন, মানুষের মুক্তির কথা ভাবেন। সে জন্যই ভেতরের অর্গল খুলে সৃজনমগ্ন হন। শিল্পী হাশেম খানও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর তুলিতে মানুষ, মানুষের অধিকার, প্রকৃতি এবং দেশের কথা মূর্ত হয়। দেশের প্রতি দায়বদ্ধ প্রত্যয়দীপ্ত বহুমাত্রিক এই শিল্পীকে জন্মদিনে আমাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। দীর্ঘায়ু হোন তিনি, এটাই প্রত্যাশা।
এম. নজরুল ইসলাম

No comments

Powered by Blogger.