জেফ বিগারস-ফুলবাড়ী কয়লাখনি এলাকাবাসীর কী হবে

ব্রিটেনের মালিকানাধীন তেল কম্পানির উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন ঠেকাতে ২৮ মার্চ বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। বাংলাদেশের সরকার ২০০৬ সালের চুক্তি বাতিল করবে, নাকি সহিংসতাকে আরো বাড়তে দেবে, তা বাকি বিশ্ব তাকিয়ে দেখবে।


বিব্রতকর উইকিলিকসের আলোকে আমেরিকানরা এবং বিশ্বের মানবাধিকার ও পরিবেশ সংগঠনগুলো এ প্রশ্নও করবে, কেন ওবামা প্রশাসন পর্দার আড়াল থেকে বাংলাদেশকে উল্টোটা করতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে অভিযুক্ত উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলনের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে, যা এক লাখ থেকে দুই লাখ মানুষকে স্থানান্তর করবে এবং অতি প্রয়োজনীয় খামার ও পানির উৎসকে ধ্বংস করে দেবে?
এর সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রকাশ হয়ে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির উক্তিতে পাওয়া যায় : 'ফুলবাড়ী প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কম্পানি এশিয়া এনার্জির ৬০ ভাগ বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের। এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তারা রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, তাঁরা খুবই আশাবাদী, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই প্রকল্পের জন্য সরকারের অনুমোদন পাওয়া যাবে।'
দুই বছর আগে একটি ব্রিটিশ রিসার্চ ফার্মের স্বাধীন রিভিউয়ে সতর্ক করা হয়েছে_'ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাংলাদেশের বিস্তৃত ফসলি জমি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলাভূমিকে দূষিত করাসহ অসংখ্য বিপদের হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এই প্রকল্পের সামারি এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (পরিবেশের ওপর প্রভাব খতিয়ে দেখা) এবং এর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (পরিবেশ এবং সমাজের ওপর প্রভাব খতিয়ে দেখা) ক্ষতি মোকাবিলায় কী করণীয়, সে সম্পর্কে নিশ্চয়তা খুবই ক্ষীণ।'
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কালচারাল সারভাইভাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটির মতে, ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প মানবিক ও পরিবেশগত ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়।
গত মাসে কালচারাল সারভাইভাল এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি বাংলাদেশের জাতীয় অ্যাডভাইজরি পরিষদের সঙ্গে একত্রে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান শুরু করেছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন বন্ধ করতে এবং পরিবেশ বিপত্তির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে।
এই সংকট বৃদ্ধির পেছনের কাহিনী জানতে আমি কালচারাল সারভাইভালের পরিচালক পলা পামারের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছি_
জেফ বিগারস : আপনি কি ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লা খনি এবং ব্রিটিশ কম্পানি নিয়ে বিতর্কের কথা সংক্ষেপে বলবেন?
পলা পামার : ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের উত্তোলন এবং প্রসপেক্টের চুক্তির পর থেকে দারুণ ঘটনাক্রম রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিবাদের কাহিনী, যে প্রতিবাদে একজন ১৩ বছর বয়সী কিশোরসহ তিনজন নিহত হয়। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে প্রতিবাদ শুরু হয় এবং সেই প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। সেই প্রতিবাদ আজও অব্যাহত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেই চলেছে। ২৮ মার্চ সংগঠকরা ঘোষণা দিয়েছেন, সরকার তাঁদের দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলো বন্ধ করে দেবেন।
এই প্রতিবাদের পেছনের শক্তিটি কী? এই প্রকল্প কমপক্ষে এক লাখ মানুষকে বাধ্য করবে স্থানান্তরিত হতে এবং তারা কৃষিজমি হারাবে, যার বিনিময়ে তাদের সমমানের কোনো জমি দেওয়ার প্রস্তাব নেই। আরো এক লাখ মানুষ পানির উৎস হারাবে, যার ফলে তাদের বাধ্য হয়ে স্থানান্তরিত হতে হবে। যারা গৃহ থেকে স্থানান্তরিত হবে, তাদের একটি বড় অংশ ২০টিরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায়ের, যারা কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছর ধরে পূর্বপুরুষের ভূমিতে রয়েছে।
জেফ বিগারস : সরকারকে আগামী জুন মাসের মধ্যে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আপনি কি কোনো আপস দেখতে পাচ্ছেন, নাকি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হবে?
পলা পামার : ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে, যেখানে ফুলবাড়ী জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে ভারত, যেটাকে প্রকল্পের ইতিবাচক দিক বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা সরকারের প্রতি চাপ দেখতে পাচ্ছি, প্রতিবাদ দেখতে পাচ্ছি। প্রতিবাদকারীদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ভারতের পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারকে এই প্রকল্প বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছে। সরকার এটাও জানে, প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে কী আচরণ করা হচ্ছে, আমরা তা পর্যবেক্ষণ করছি। লাখ লাখ নাগরিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিভাবে একটি প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে?
জেফ বিগারস : কালচারাল সারভাইভাল ফুলবাড়ীর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হলো কিভাবে?
পলা পামার : কালচারাল সারভাইভালের একটি প্রকল্পে যেসব আদিবাসী সম্প্রদায় নিজেদের ভূমি এবং অধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করছে, তাদের অনুরোধে আন্তর্জাতিকভাবে একটি চিঠি লেখার জন্য প্রচারাভিযান করে। জানুয়ারি মাসে আমরা বাংলাদেশের জাতীয় আদিবাসী পরিষদ থেকে একটি চিঠি পাই। তারা সেই চিঠিতে আমাদের ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের বিরুদ্ধে সমর্থন দিতে অনুরোধ জানায়। ওই প্রকল্পের পক্ষ থেকে বলা হয়, দুই হাজার ৩০০ আদিবাসীকে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের খামার ও গৃহ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু জাতীয় আদিবাসী পরিষদের স্বাধীন গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, এসব মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ হাজার।
জেফ বিগারস : আপনি কি বলবেন, ফুলবাড়ী কয়লাখনির কারণে স্থানীয়দের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
পলা পামার : খনি এলাকা থেকে হাজার হাজার পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে সরে যেতে হবে। কম্পানি তাদের সমপরিমাণ জমি দিতে পারবে না। এর কারণ হলো, জমি নেই।
জেফ বিগারস : এসব গ্রামবাসীকে সমর্থন জানাতে আমেরিকানরা বা অন্য বিদেশিরা কী করতে পারে?
পলা পামার : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিতে পারে! এই সংকট থেকে প্রধানমন্ত্রী বিদেশিদের দ্বারা ব্যবহার হওয়ার পুরনো ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নামকে উজ্জ্বল করতে পারেন। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়ানক ভুক্তভোগী হবে। সেই বিবেচনায়ও তো কয়লা প্রকল্প বাতিল করতে পারেন, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী। আন্তর্জাতিক জনগণের চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে একটি ঐতিহাসিক এবং নৈতিক অবস্থান গ্রহণে।

অল্টারনেট (অনলাইন) থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.