জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি-জন্মের হীরক জয়ন্তীতে যতীন সরকার by স্বপন ধর

আরে... আরে... আরে... এতটুকুন পুঁচকে ছেলে আবার বক্তৃতা দেয় নাকি! চোঙা ফুঁকিয়ে বেশ তো বড় বড় কথা বলে যাচ্ছে। বড় হলে এ ছেলে কেউকেটা গোছের একটা কিছু হবেই।' হয়েছেনও তাই। বাবা জ্ঞানেন্দ্র সরকার টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে ছেলের কারিশমা দেখেন। ছোট ভাইকে দর্শক বানিয়ে বক্তৃতার পর বক্তৃতা দিয়ে চলছে শান্তি নামের একটি ছেলে। শান্তি তার ডাক নাম।
বড় বেলায় পরিবারের শান্তি আনা সেই ছেলের আসল নাম? যতীন সরকার। ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান নেত্রকোনা সদর থেকে ১০ মাইল দূরে কেন্দুয়া থানার রামপুরে। রামপুর বাজারের নিকটবর্তী চন্দপাড়া গ্রাম। গ্রাম থাকলে কী হবে। রাজনীতি-সংস্কৃতির তাবৎ খবরাখবর মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত সেই গ্রামে। রামপুর বাজার ছিল এমন একটি বাজার; যেখান থেকে এ খবর ছড়াত। তাই রামপুর যতীন সরকারের কাছে দুনিয়ার জানালা। কৈশোরে যাঁর খেলাধুলা করার কথা, কিচ্ছা শোনার কথা সেই কৈশোরেই তিনি বঙ্কিম-মধুসূদন-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বই পড়ে নতুন জগতে প্রবেশ করেন; কিন্তু দারিদ্র্য তাকে তাড়া করে ফেরে। ফলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই রামপুর বাজারে তাঁকে দোকান খুলে বসতে হয়। ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করলেও অর্থাভাবে এক বছর বিরতি দিয়ে ১৯৫৬ সালে তাঁকে নেত্রকোনা কলেজে ভর্তি হতে হয়। তারপর লজিং থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। এখানেও লজিং থেকে শুরু হয় বিএ পড়া। ১৯৫৯ সালে বিএ পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষকতায় যোগ দেন আশুলিয়া হাই স্কুলে। তারপর কিছুদিন বারহাট্টা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬১ সালে প্রাইভেট পড়িয়ে টাকা জোগাড় করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে ভর্তি হন। ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি। ২০০২ সাল পর্যন্ত এ কলেজেই পাঠদান করতেন তিনি। শিক্ষাদানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য শ্রেণীকক্ষ থেকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাঁর ঈর্ষণীয় স্মরণশক্তি সবার মাঝে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। আজও ৭৫ বছর বয়সে বিধ্বস্ত শরীর নিয়েও উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি মুখস্থ বলতে পারেন তিনি। ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি-সংস্কৃতি যখন যে অস্ত্র প্রয়োজন তাই প্রয়োগ করে যান। সক্রেটিস-অ্যারিস্টটল-রুশো-কার্ল মার্কস থেকে শুরু করে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে অগ্রজ এবং সমসাময়িক_এমনকি মেধাবী অনুজদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেন সাবলীল ভঙ্গিমায়।
চোঙা ফোকা সেই বালক ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর নতুন করে রাজনীতিতে হাতেখড়ি দেন। ১৯৪৮ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনের পক্ষে মিছিল করেন। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং নেত্রকোনা কলেজ সংসদে 'সাহিত্য সম্পাদক' নির্বাচিত হন। তার পরে মহকুমা ছাত্রলীগের সহসভাপতি হন। বিএ পড়ার সময় কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন 'প্রগতি'র সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২, '৫৪, '৫৮, '৬২, '৬৯ ও '৭০-এর প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাসংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক কারণে তিনি কারাবরণ করেন। কারাগারে বসেই তিনি লেখেন 'ব্যাকরণ ভয় অকারণ' গ্রন্থ এবং 'সব পাওয়ার মন্ত্র' নাটক। তিনি লালন-হাছন-জালালসহ লোকগানের মরমি কবিদের মানবতাবাদী আদর্শ গ্রহণ করেন এবং সে আদর্শে আজও তিনি অবিচল। কলেজে পাঠকালে তিনি যে মার্কসবাদী দীক্ষা নিয়েছিলেন তা এখনো অটুট। মার্কসবাদ তাঁকে এতই আকৃষ্ট করে যে তাঁর চলনে-বলনে, যাপিত জীবনে, সমাজতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালিও যে সমাজতন্ত্রের ঐতিহ্য বহন করে, তা তিনি গ্রন্থ ঘেঁটে উপস্থাপন করেন। আজ ২০১১। তিনি ৭৫-এ।
স্বপন ধর

No comments

Powered by Blogger.