আমাদের সিদ্দিকা আপা by কেকা ফেরদৌসী

বাংলাদেশের শহর-গ্রাম সর্বত্র অগণিত নারীর সাক্ষাৎ পাবেন, যাদের 'কী করেন' প্রশ্ন করা হলে অভিন্ন উত্তর মিলবে_ কিছু না। পরিবারের সবার জন্য রান্নার কাজে সূর্যোদয়েরও আগ থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চুলার উত্তাপের কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা, পাশাপাশি সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালনের পরও এমন উত্তর! আমাদের সবার প্রিয় সিদ্দিকা কবীর এ ধারণা পাল্টে দিতে সচেষ্ট ছিলেন এবং বলতে পারি যে তাতে তিনি সফলও। তিনি বলতেন, রান্নাও তো একটি কাজ।


সেটা কেউ ঘরে করে, কেউবা বাইরে। এর পেছনে আছে শ্রম, ঘাম ও সৃজনশীলতা। আর কাজ করলে তার দাম বা বিনিময়মূল্য থাকে। কোনো কাজই ফ্রি করা উচিত নয়। তিনি নবীন প্রজন্মের রন্ধন বিশেষজ্ঞ ও শিল্পীদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল করতে চেয়েছেন। তার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচয় এক যুগেরও বেশি হয়ে গেল। প্রথম দিকে তাকে মনে হতো গম্ভীর প্রকৃতির লোক। এ ধারণা পাল্টে যেতে সময় লাগেনি এবং সেটা তার গুণেই। একসঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে থেকেছি। কখনও রান্নার অনুষ্ঠানের বিচারক, কখনওবা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী। আমার মায়ের চেয়েও বয়সে তিনি বড়, কিন্তু আপা বলে ডাকলে হাসিমুখেই তা মেনে নিয়েছেন। তিনি যখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে রান্নার অনুষ্ঠান করতেন, তখন স্টুডিওর সেটে চুলার ব্যবস্থা করা যেত না। বেতারের অনুষ্ঠানের মতো মুখে সব বলতেন এবং প্রস্তুত প্রণালি শেষে বাড়ি থেকে তৈরি করে আনা খাবারটি দর্শকদের দেখাতেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে রান্নার অনুষ্ঠান চালু হওয়ায় তিনি ঘরে ঘরে শুধু পরিচিত মুখ নয়, প্রিয় মুখও হয়ে ওঠেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লিখেছিলেন 'খাদ্য, রান্না ও পুষ্টি' বই। এ পর্যন্ত এর ছয়টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ সংস্করণের বইটি তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। গ্রাম ও শহরে নতুন গৃহিণীদের জন্য এ বই উপহারের তালিকায় থাকেই। সময়ের বিবর্তনে বইটির প্রকৃত নাম অনেকেই বলেন না_ 'সিদ্দিকা আপার রান্নার বই' বললেই সবাই বুঝে যায়। তিনি খাদ্যের পাশাপাশি পুষ্টিগুণের কথা বলতেন। একবার চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠানে আমরা দু'জন অংশ নিই। এতে ছয়জনের একটি পরিবারের সবার জন্য মাত্র ২০০ টাকায় চারবেলা কীভাবে পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করি। দামি খাবার হলেই পুষ্টিকর_ এ ধারণার পক্ষে তিনি ছিলেন না। এখন অনেকেই তার পাশে রয়েছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও এ কথা বলছেন। তিনি গণিতশাস্ত্র বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। আমি অনেক দেশের রান্না শিখেছি দেখে খোলামনে প্রশংসা করতেন এবং অন্যদেরও বলতেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি অনেক অনুষ্ঠানে যেতে পারতেন না। যারা আমন্ত্রণ জানিয়ে তার কাছে যেত, তাদের বলতেন আমাকে নিয়ে যেতে। এটা ছিল আমার জন্য পরম সম্মান ও সন্তোষের। অর্থ দিয়ে তা কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। ব্রিটেনের কারি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, রান্নার কাজ করেও বড় স্বীকৃতি মেলে । আমরা কে কী করছি, কার কোথায় সাফল্য_ সব ছিল তার জানা। মুক্ত ও উদারমনা হওয়ার কারণেই এমনটি হতে পেরেছে। কারও সঙ্গে তার ঝগড়া-ফ্যাসাদ হয়েছে, এমনটি শুনিনি।
আপার মৃত্যুর খবর পেয়েছি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তিনি কেমন আছেন জানতে চেয়ে ফোন করেছি। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল_ একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো। আমাকে শোকাচ্ছন্ন করে তার বোন জানালেন, একটু আগেই সিদ্দিকা কবীর আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন।
আমাদের একটি র্অিভন্ন স্বপ্ন ছিল_ রান্না বিষয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন। এ বিষয়ে অনেক পরিকল্পনা আমরা করেছি। কিছু কাজও এগিয়েছে। দেশে এবং দেশের বাইরে অনেক দেশে শেভদের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিবেচনাতেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ঘরে ঘরে প্রতিদিন সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার তৈরি। তিনি নেই, কিন্তু এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ হবেই। তাকে স্মরণে রাখার, তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।

কেকা ফেরদৌসী :রন্ধন বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.