ভারত-বাংলাদেশ বিদ্যুত্ বিনিময়ঃ আশঙ্কার দিকগুলো by ড. মাহবুব উল্লাহ্

একটি ইংরেজি দৈনিকের খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের একটি দল গত নভেম্বর মাসে দিল্লি সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যুত্ খাতে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সমঝোতা স্মারকটিকে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।
বলা হয়েছে, এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ভারত ও বাংলাদেশ পারস্পরিকভাবে বিদ্যুত্ আমদানি ও রফতানি করতে পারবে। ভারতের সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাত থেকেই বাংলাদেশ বিদ্যুত্ ক্রয় করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ জানিয়েছেন, সমঝোতা স্মারকটির ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময় একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। চুক্তির ফলে উভয় দেশ একে অপরের কাছ থেকে বিদ্যুত্ ক্রয় অথবা একে অপরের কাছে বিদ্যুত্ বিক্রয় করতে পারবে। অবশ্য বিষয়টি নির্ভর করবে প্রাপ্যতা, প্রয়োজন এবং বিদ্যুতের দামের ওপর। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে তীব্র বিদ্যুত্ সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও কী করে বাংলাদেশ বিদ্যুত্ বিক্রয় করবে— তখন জনাব আজাদ জানান, বাংলাদেশে যখন বিদ্যুত্ উদ্বৃত্ত হবে তখনই বাংলাদেশের বিদ্যুত্ বিক্রয়ের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে। এর আগে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা গিয়েছিল, ভারত বাংলাদেশের কাছে মাত্র ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ রফতানি করবে। বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুত্ ঘাটতির তুলনায় ১০০ মেগাওয়াট যে একেবারে অতিসামান্য তা বলাই বাহুল্য। এখন বলা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে ভারত থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ আমদানি করা সম্ভব হবে। কিন্তু এই অদূর ভবিষ্যত্ কত দূর? বিদ্যুত্ আদান-প্রদানের পরিকাঠামো স্থাপন করতেই লেগে যাবে কমপক্ষে ২ বছর। আরও জানা গেছে, দুই দেশের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের ঈশ্বরদী এবং পশ্চিমবাংলার বহরমপুরকে বিদ্যুত্ সংযোগ প্লান্ট স্থাপনের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এই দুটি স্থানেই সর্বাধিক কম সময়ে সংযোগ প্লান্ট স্থাপন করা সম্ভব বলে দাবি করা হয়েছে। ভারত থেকে সে দেশের পাওয়ার মিনিস্ট্রির একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি টিম ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ ঢাকায় এসেছে। তারা বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি এবং পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করেছে। এই বৈঠকটি ছিল ১৮ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর ২০০৯ বাংলাদেশের বিদ্যুত্ সচিবের নেতৃত্বে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে দিল্লিতে যে বৈঠক হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতা।
সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী বাংলাদেশের পিডিবি এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি যৌথ উদ্যোগে দুই দেশে বিদ্যুত্ প্লান্ট স্থাপন করতে পারবে। সমঝোতা স্মারকে ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি অব ইন্ডিয়া কর্তৃক বাংলাদেশের পিডিবির কর্মকর্তাদের প্লান্ট রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্লান্ট ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে অনেকের কাছেই প্রস্তাবিত চুক্তিটিকে খুবই নির্দোষ এবং বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলেই প্রস্তাবিত চুক্তিটির ঝুঁকির দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। আমাদের হাতে সমঝোতা স্মারকটির পূর্ণ ভাষ্য নেই। যা কিছু মন্তব্য করা হবে তার ভিত্তি সংবাদপত্রের রিপোর্ট। সমঝোতা স্মারকে দুই দেশের মধ্যে প্রাপ্যতা, প্রয়োজনীয়তা ও দাম অনুযায়ী বিদ্যুত্ বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি যদি বিনিময়ের প্রশ্ন হয় তাহলে দামের প্রশ্ন কেন উঠছে? সহজ ভাষায় বিনিময় বলতে আমরা বুঝি সমপরিমাণ জিনিসের বিনিময়। যেমন গ্রামে বাস করা একটি বাড়িতে কোনো পরিবারের যদি রান্নার তেল না থাকে তাহলে পাশের পরিবারটির কাছ থেকে তেল ধার করতে পারে। বিনিময়ে ওই পরিবারটি অন্য পরিবারকে পরবর্তী সময়ে সমপরিমাণ তেল পরিশোধ করে দায়দেনা মিটিয়ে ফেলতে পারে। সরল পণ্য উত্পাদনের অর্থনীতিতে এ ধরনের বিনিময় প্রায়ই ঘটে থাকে। কৃষি কাজে বদলি শ্রম এ ধরনেরই একটি বিনিময়। কিন্তু বিদ্যুতের মতো একটি পণ্যের ক্ষেত্রে এ রকম সরল বিনিময় অর্থনীতির পণ্ডিতরা মানতে চাইবেন না। কারণ, একই দিনে উত্পাদিত বিদ্যুতের দামে হেরফের ঘটতে পারে। বাড়তি চাহিদাকালীন বিদ্যুতের দাম কমতি চাহিদাকালীন বিদ্যুতের দামের সমান হতে পারে না। পরিবহনের ক্ষেত্রে বাড়তি ও কমতি চাহিদার মধ্যে দামের পার্থক্য ঘটানো বেশ সহজ। নগরীতে যখন যানবাহনের উপর যাতায়াতের প্রবল চাপ থাকে তখন ওই সময়ে যাত্রীদের কাছ থেকে টিকিটের মূল্য বেশি দাবি করা যুক্তিযুক্ত। অন্যদিকে পরিবহনের উপর যে সময়টায় চাপ কম থাকে তখন ভাড়া কম রাখা একইভাবে যুক্তিযুক্ত। এই ব্যবস্থাপনার সুবিধাটা এই যে, পিক আওয়ারে যাদের পথে বেরুনোর দরকার নেই তারা বাড়তি ভাড়া গোনার কারণে পথে বেরুতে নিরুত্সাহিত হয়। অন্যদিকে অফ-পিকআওয়ারে যাত্রী কম থাকায় পরিবহন কোম্পানিগুলোর যে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তা কম ভাড়ায় উত্সাহিত হয়ে লোকজনের বাড়তি ভ্রমণের ফলে পুষিয়ে ওঠা সম্ভব। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বিদ্যুত্ উত্পাদন পরিস্থিতি এতই নৈরাশ্যজনক যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতে বিদ্যুত্ রফতানির কথা চিন্তা করাও হাস্যকর। তাহলে যেভাবে চুক্তিটি হতে যাচ্ছে অর্থাত্ বিনিময় চুক্তি, তা থেকে এ কথাই ভাবা স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশ বহু বছর পর্যন্ত আমদানিকারকই থেকে যাবে। তাহলে প্রতিদিন ভারত থেকে আনা বিদ্যুত্ সেই দিনই ফেরত না দেয়ার জন্য বাংলাদেশকে সুদ গুনতে হবে কিনা? কারণ, আমরা জানি বিলম্বে পরিশোধের জন্য সুদ যোগ করে বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হয়। একটি সংবাদপত্রে রিপোর্ট করা হয়েছে, ভারত রাতে বিদ্যুত্ দেবে এবং বাংলাদেশ দিনে বিদ্যুত্ দেবে। দিন ও রাতের বিদ্যুতের দামে কোনো হেরফের ঘটবে কি? রাতের প্রথমার্ধের বিদ্যুত্ চাহিদা ও দ্বিতীয়ার্ধের বিদ্যুত্ চাহিদার মধ্যে বিশাল হেরফের থাকে। দিনে আলোর জন্য বিদ্যুতের চাহিদা কম হলেও কলকারখানার জন্য বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। এসব তারতম্যগুলো দাম নির্ধারণের ওপর প্রভাব ফেলার কথা। এসব জটিল প্রশ্নের সমাধান কীভাবে চিন্তা করা হয়েছে সে সব এদেশের আমজনতার কাছে স্পষ্ট নয়। খারাপ চুক্তি করার ইতিহাস এদেশে আছে। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার যে চুক্তি করেছিল সে চুক্তিটি চুক্তির ভাষা ও শর্তাবলীর বিচারে একটি অত্যন্ত দুর্বল চুক্তি ছিল। এতে ছিল না গ্যারান্টি ক্লজ এবং ছিল না বিরোধের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সালিশ নিষ্পত্তির ধারা। আলোচ্য বিদ্যুত্ কেনাবেচার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের বাজার কাঠামোটিও গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। অর্থনীতির একজন সাধারণ ছাত্রও জানে, বাজারে যখন তথ্যের পূর্ণ প্রবাহ থাকে এবং ক্রেতা ও বিক্রেতার সংখ্যা অনেক থাকে তখন বাজার হয় পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক। এ রকম বাজারে বাড়তি মুনাফার কোনো অবকাশ থাকে না। প্রতিযোগিতার নিয়মেই পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। ঠিক তার বিপরীতটি ঘটে একচেটিয়া (গড়হড়ঢ়ড়ষু) বাজারের ক্ষেত্রে। একচেটিয়া বাজারে বিক্রেতা থাকে একজন, ক্রেতা থাকে অনেক। ক্রেতারা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু বিক্রেতাকে কোনো প্রতিযোগিতা করতে হয় না। ফলে বিক্রেতার ইচ্ছাতেই দাম নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশ যখন ভারত থেকে বিদ্যুত্ কিনবে তখন বিক্রেতা একজন (ভারত রাষ্ট্র), ক্রেতাও একজন (বাংলাদেশ রাষ্ট্র)। এরকম বাজারকে অর্থনীতি শাস্ত্রে বলা হয় ইরষধঃবত্ধষ গড়হড়ঢ়ড়ষু বা দ্বিপাক্ষিক একচেটিয়া বাজার। এরকম বাজারে অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী ভারসাম্যমূলক দাম নির্ধারিত হয় না। দাম নির্ধারণে চালাকি, চালবাজি, নানা ধরনের অপকৌশল কাজ করে। তাহলে যৌক্তিক দাম নির্ধারণের কী হবে? আসলে ভারত বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুত্ বিক্রয় করে ছলচাতুরি করে শুধু বেশি দামই আদায় করবে না, তার সঙ্গে অনেক বেশি ফায়দা তুলে নেবে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থাত্ ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, মনিপুরে ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে যাচ্ছে। আঞ্চলিকভাবে এই বিদ্যুতের ১০ থেকে ২০ শতাংশের বেশি চাহিদা উত্তর-পূর্ব ভারতে নেই। ভারত এই অঞ্চলে উদ্বৃত্ত বিদ্যুত্ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিল্পোন্নত রাজ্যগুলোতে নিতে চাচ্ছে। ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও বেশি। এ কারণে তার নিজস্ব বিদ্যুত্ চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। কিন্তু উদ্বৃত্ত বিদ্যুত্ পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহ করতে হলে যে ট্রান্সমিশন লাইন এবং সংযোগ প্লান্ট করতে হবে সেটা বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই করতে হবে। সঙ্কীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরে সেটা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ যদি ভারতকে তার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুত্ পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করে তাহলে সেটা হবে ভারতকে কার্যত বিদ্যুত্ করিডোর দেয়া। এই বিদ্যুত্ করিডোর পেলে ভারতের জন্য কত বড় পাওয়া হবে তা পাঠক বিবেচনা করে দেখতে পারেন। ভারতকে এই সুযোগটি দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কোনো প্রকার ভাড়া দাবি করছে কি? এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিষয়। এর পাশাপাশি কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন— বাংলাদেশ যদি কখনও বর্তমানে অনুসৃত দিল্লিমুখী পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটায় তাহলে ভারতের আচরণ কী হবে। সে ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে বিদ্যুত্বঞ্চিত করে জিম্মি করে ফেলতে পারে। অতীতে ভারত বাংলাদেশের প্রতি যে ধরনের আচরণ করেছে তার ভিত্তিতে এরকম আশঙ্কা করা অমূলক নয়। তবে এই আশঙ্কার পাল্টা যুক্তি হিসেবে কেউ কেউ হয়তো বলবেন প্রযুক্তিগতভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটা প্রায় অসম্ভব। কারণ, ট্রান্সমিশন লাইন যদি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যায় তাহলে সেটা বন্ধ করার মানে হবে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলেও সরবরাহ বন্ধ করা। কিন্তু সবই নির্ভর করে ট্রান্সমিশন লাইনের ডিজাইনের ওপর। ভারত তার পশ্চিমাঞ্চলের জন্য যে বিদ্যুত্ সরবরাহ করবে প্রযুক্তিগতভাবে তার জন্য পৃথক চ্যানেল রাখা কি অসম্ভব? সেক্ষেত্রে সামরিকভাবে দুর্বল বাংলাদেশ কি পারবে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে? সুতরাং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বিদ্যুত্ বিনিময়ের ব্যাপারটি যত সহজ সরল মনে হয় তত সহজ সরল নয়। বিগত ৩৮ বছরে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বড়ই করুণ। চানক্যের মতে, নিকটতম প্রতিবেশী যেমন খুব ভালো বন্ধু হতে পারে, তেমনি হতে পারে প্রবলতম বৈরী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কণ্টকাকীর্ণ থেকেছে।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.