আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায় রাষ্ট্র ও সমাজের by লুৎফর রহমান রনো

পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটি দৈনিকের নিবন্ধের শিরোনাম চোখে পড়ল_'সাত বছরে ৭৩ হাজার আত্মহত্যা'। শিরোনাম দেখে ভেবেছি সারা বিশ্বের আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর পরিসংখ্যান বা পৃথিবীর কোনো আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকার কথা। কিন্তু পুরোটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।


আমার দেশে, এই বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২৯ জন আত্মহত্যা করে, যা এক মাসে হয় ৪৭৪ এবং সেই হিসাবে ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে আত্মহননের মধ্য দিয়ে জীবনের যন্ত্রণা চুকিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে ৭৩ হাজার প্রাণ। এই ব্যাপকসংখ্যক আত্মহত্যার কথা আমার মতো অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও পুলিশের নথিপত্রের সূত্রে তা-ই সত্য। আর এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে পারিবারিক কলহ, প্রেম, পরকীয়া, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, দারিদ্র্য ইত্যাদি। মানুষের মনোজগত নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁরা নানাভাবে এর ব্যাখ্যা করে থাকেন। তবে সব ব্যাখ্যার ভেতরে যে সত্য খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলো মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাহীনতা ও সামাজিক অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকার না হওয়া, অর্থাৎ আইনের অস্বাভাবিক শিথিলতা। বিশেষ করে যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সমাজে নেই, তাদের জানমাল, সম্মানের সুরক্ষা দিতে পারে না দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন ঘটনার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। সর্বশেষ যে মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জে, তা প্রকাশিত হয়েছে ১৬ তারিখের দৈনিকগুলোতে। একজন মা তাঁর চার-চারটি সন্তান নিয়ে ঝাঁপ দেন চলন্ত ট্রেনের নিচে। মা ও দুই সন্তান তৎক্ষণাৎ মারা যান। দুটি শিশু বেঁচে আছে। এই শিশুদের বাবা থাকেন দুবাইতে। তাদের মায়ের বিরুদ্ধে গ্রামের মাতব্বররা অপর পুরুষের সঙ্গে 'অবৈধ' সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ তুলে সালিস ডেকে তাঁকে 'সমাজচ্যুত' করে। অথচ এ অভিযোগ যে মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, পরিবারের অন্য সদস্যদের (স্বামীর ভাইয়েরা ও অন্যান্য) পরশ্রীকাতরতা (টাকা-পয়সা আছে, সচ্ছল) থেকে বিদ্বেষমূলক তা আগে-পরে প্রমাণিত হয়েছে। তবুও তথাকথিত মাতব্বররা তাঁর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র ও সালিস নামের প্রহসন করে যেন একপ্রকার নারী নির্যাতন জাতীয় বিকৃত আনন্দ লাভ করেছে। আর এমন বিকৃতমনা নিষ্ঠুর নারী নির্যাতক মাতব্বরদের অমানবিক কর্মকাণ্ডের কথা আমরা হামেশা পত্রিকার পাতায় পড়ে থাকি। কেউ অবশ্য এ কথা তুলবে না, কারণ এ সমাজে এর নিয়ম নেই_পুরুষের অবৈধ যৌন সম্পর্কের কথা প্রমাণিত হলে কখনো কোনো পুরুষকে সমাজচ্যুত বা কোনো রকম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল কি? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের চরিত্র স্খলনে কোনো দোষ নেই বা বলা যায় পুরুষে অসচ্চরিত্র, অসভ্য, ধর্ষক, নারী নির্যাতক, নারী হত্যাকারী হওয়ার অলিখিত লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। কোনো নারীর পিতৃপরিবার যদি প্রভাবশালী হয়, তবে মামলা হয়, দোষী পুরুষটি কাঠগড়া পর্যন্ত যায়, কখনো শাস্তিও হয়। প্রথমত, সমাজ হলো পুরুষ-আধিপত্যবাদী, দ্বিতীয় ধনী-দরিদ্র্যে বৈষম্য। তার ওপর কোনো মামলার বাদী যদি নারী হয়, আর সামাজিকভাবে তার কোনো প্রতিপত্তি না থাকে, তাহলে সমাজে তার লাঞ্ছনা আরো বৃদ্ধি পায়। অতঃপর নানা দুর্ঘটনা ঘটে, এমনকি আত্মহনন পর্যন্ত। অথচ এই অন্যায়, অসম নিয়ম ও আইন প্রতিষ্ঠিত আমাদের সমাজে।
পরিতাপের বিষয়, এত অনিয়ম ও বৈষম্যমূলক নির্যাতনের কোনো প্রকার প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাচ্ছে না। তার ওপর আমরা জানি, নারী উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে রাজধানী শহরে নারী নির্যাতক পুরুষ শ্রেণীর প্রতিনিধি তথাকথিত মোল্লারা মিছিল করেছে। এ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে, পাকিস্তান-আফগানিস্তানি চরম মৌলবাদের বীজ আমাদের দেশে-সমাজে গেড়ে আছে। তাদের পেছনে কোনো না কোনো শক্তি রয়েছে, যাদের সাহস ও উসকানিতে তারা মানবতার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে মিছিল ও পুলিশের সঙ্গে লড়াই করার মতো স্পর্ধা দেখাতে পারে। এই অপশক্তি আবার তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে আমাদের দেশের নোংরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। তাই অনেক সময় রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলেও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নানারূপ আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করলেও তা সমাজে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। যার ফলে আমরা নারীর অসহায় আত্মসমর্পণ দেখছি আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মধ্যে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আসলে কোনো নারীই কিন্তু দোষী নয়। অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে না যদি পুরুষ তাকে পথ না দেখায়। আমাদের সমাজে হামেশা যা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, তা হলো পুরুষের অসামাজিক কাজ বা ব্যভিচারের শাস্তিটাও ভোগ করে নারী। তাই নিশ্চিত করে বলা যায়, মাতব্বর, ইউপি সদস্য বা এ রকম প্রভাবশালী লোকগুলো তাদের নিজেদের আপাত অবদমিত রুগ্ণ মনের বিষ উদ্গিরণ করে এসব অসহায় নারীকে নির্যাতনের মাধ্যমে। তাদের এই অমানবিক বিকৃতিকে ধর্মের আড়ালে লালন করতে সাহায্য করে অশিক্ষিত, মূর্খ মোল্লারা ও তথাকথিত রাজনৈতিক দল। আর তাদের প্রশ্রয় দিয়ে থাকে সমমনা প্রভাবশালী রাজনীতিকরা, যারা রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতে পারে_এ রকম একটি অদৃশ্য কিন্তু অনিবার্য সুতায় গাঁথা এসব মানুষরূপী পশু। সচেতন নাগরিকদের উচিত সেই অদৃশ্য সুতো, তাঁদের পারস্পরিক রক্ষাকারী সংযোগটাকে বুঝে নেওয়া। রাজনৈতিক, মানবিক ও উন্নতি, সর্বোপরি নারীসমাজকে রক্ষার স্বার্থে যেকোনো ধরনের ধর্মীয় ঢাল ভেঙে দিতে হবে আইন করে। আরো কঠোর হতে হবে সরকারকে। তাৎক্ষণিক বিচারের ব্যবস্থা করলে কিছুটা হ্রাস পেতে পারে নারীর প্রতি অমানবিক নির্যাতনের মাত্রা।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.