রাবিতে শিক্ষক নিয়োগঃ দলীয়করণের বিরল পদ্ধতি!

বিদায়ী বছর ২০০৯-এর শেষ দিবসের অপরাহ্নে দলীয়করণের আরেকটি নজির স্থাপন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর আগে শিক্ষাঙ্গন ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের বিস্তর অভিযোগ থাকলেও এবারের ঘটনায় যোগ হয়েছে অভূতপূর্ব চমক। প্রথামাফিক কর্তৃপক্ষ শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিল।

কিন্তু তাতে যে সংখ্যক পদের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল শেষ পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থীদের বাদ দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নতুন ইংরেজি বছরের সূচনা করল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ—একথা বলা যায়।
জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৬টি পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পদগুলোর বিপরীতে নিয়োগ দেয়া হয় ৭৪ জনকে। অর্থাত্ শূন্য পদের চেয়েও ২৮ জন অতিরিক্ত শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২৮তম সিন্ডিকেট বৈঠকে ১০ বিভাগে ওই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। তবে আলোচ্য ১০ বিভাগের মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চাওয়া পাঁচটি পদের বিপরীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে মাত্র একজনকে। অভিযোগ উঠেছে যে, ওই বিভাগে নিয়োগের জন্য নিজেদের পছন্দসই বিশ্বস্ত দলীয় প্রার্থী না পাওয়ার কারণে বিজ্ঞপিত চারটি পদে লোক নেয়া হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, এর আগে বর্তমান প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি বিভাগে দলীয় বিবেচনায় ৫০ শিক্ষকের নিয়োগ চূড়ান্ত করে। এই অনিয়মটি করা হয়েছিল গত ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৪২৭তম সভায়। তখন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী যোগ্য ও মেধাবীদের বাদ দিয়ে দলীয় বিবেচনায় তুলনামূলক কম যোগ্যতাসম্পন্নদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। এবার সেই অনিয়মেরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। এভাবে নিয়োগ দেয়া প্রসঙ্গে আলোচ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন বলেছেন, যেভাবে প্রশাসনের নিজস্ব চিন্তাধারায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল। তিনি সিন্ডিকেট বৈঠকে ৭৪ জন শিক্ষকের নিয়োগের সত্যতা স্বীকার করে এও বলেছেন, এর আগে বিজ্ঞাপনে চাওয়া প্রয়োজনীয় পদের দ্বিগুণ ও দলীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্থিত দলের শিক্ষকদের অবস্থান মজবুত করতে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি ও সভাপতির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা হয়েছে। এসব তথ্যের আলোকে আর বলার অবকাশ থাকে না যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আলোচ্য নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নৈতিকতা এবং বিধিনিয়মের ধার ধেরেছেন।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শূন্যপদে জনবল নিয়োগের সবক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনার অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে আসছে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে এমপি ও সরকারি দলের নেতারা পছন্দের লোক নিয়োগ দিতে তদবির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সিভিল সার্জন অফিস, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নিয়ে দলীয়করণের অভিযোগ উঠে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির বিধান ও দীর্ঘদিনের পদোন্নতির ঐতিহ্য লঙ্ঘন করে বিশেষ ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। বদলির ক্ষেত্রেও দলীয়করণ যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়েছে। আশা করা গিয়েছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অনিয়মের উপদ্রব কমবে। কিন্তু বছর পূর্ণ হওয়ার শেষ দিনেও সে ধারা অব্যাহত থাকল। শুধু তাই নয়, এক লজ্জাজনক নজির স্থাপন করল দেশের একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ! এমনিতে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ মোটেই আশানুরূপ নয়। সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের হল দখলসহ বিভিন্ন তাণ্ডবে বিগত বছরে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তপাতের নৃশংস ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোপুরি সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে না আসতেই শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের ঘটনা যে কোনো বিবেচনায় দুঃখজনক এবং প্রতিকারযোগ্য। আমাদের প্রত্যাশা, শিক্ষাঙ্গন এবং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের স্বার্থে সরকার উত্থাপিত অভিযোগ নিরসন করতে পিছপা হবে না।

No comments

Powered by Blogger.