গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং উপকূলীয় জনগণ by মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় স্বজনদের কাছে ফোন করতেই ছোট বোন স্কুল শিক্ষিকা জানাল—আমাদের বাড়ি-ঘর নাকি পানিতে তলিয়ে যাবে, ভালো থাকব কীভাবে? এরকমই একটা খবর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করেছে ক’দিন আগে।

খবরে দেখলাম কি দ্রুত বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চল পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ মডেল চিত্রটির পরপরই দেশের প্রধান ব্যক্তিরা বক্তব্য দিচ্ছেন, দেশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে, কোপেনহেগেন সম্মেলনে। টাকাটা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে না এনে কীভাবে সরাসরি পাওয়া যায় তারও হিসাব-নিকাশ করছিলেন। কিন্তু এই সাহায্যটা কীভাবে কাজে লাগাবে বা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের উপকারে আসবে, তার বিন্দুমাত্র বর্ণনা সেখানে ছিল না। যতদূর জেনেছি, গত একশ’ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, কিন্তু আগামী একশ’ বছরে অর্থাত্ ২১০০ সালে তা ২ থেকে ৬ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা প্রায় ১ থেকে ২ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর থেকেও ভয়াবহ বার্তা হচ্ছে, তাপমাত্রার এই পরিবর্তনে পৃথিবীর জলবায়ুতে একটা মারাত্মক পরিবর্তন আসবে। অসম বৃষ্টিপাতসহ সাইক্লোনের তীব্রতা অনেক বাড়বে। জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক পরিবর্তনসহ ফসল উত্পাদন ও প্রাণীকূলের জীবনযাপনে ব্যাপক প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য সাইক্লোনসহ মৌসুমী ঝড়ের তীব্রতা প্রচণ্ড হারে বেড়ে যাবে। ২০০৭-এর সুপার সাইক্লোন ‘সিডর’ এবং এ বছরের ‘আইলা’ এদেরই আগাম সঙ্কেত। মৌসুমী ঝড়ের তীব্রতা প্রচণ্ড হারে বেড়ে যাবে। সিডর-এর সেই ধ্বংসলীলা টেলিভিশনেও দেখেছি, তাও ঘটনার কয়েক দিন পর। সারি সারি গাছপালা, ঘর-বাড়ি, রাস্তায় পড়ে গিয়ে দক্ষিণাঞ্চল পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে সেই ধ্বংসস্তূপে কী ঘটেছিল, কারা তখনও বেঁচে ছিল—সাইক্লোন শেষ হওয়ার পরও অন্তত দুদিন আমরা জানতে পারিনি। অবশেষে দেশের কর্তাব্যক্তিরা হেলিকপ্টারে করে মঠবাড়িয়ায় পৌঁছেছেন, সঙ্গে টিভি ক্যামেরা, সেই সুবাদে ধ্বংসলীলার দৃশ্য খানিকটা দেখেছি। আনাচে-কানাচে অনেক না জানা সেই বীভত্স ঘটনা পড়ে জানতে পেরেছি। বিদেশ থেকে সাহায্য এসেছে অনেক কোটি টাকা, হয়তো তা বিতরণও করা হয়েছে (!) কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেড়াতে গিয়ে পিরোজপুরের চরখালী থেকে মঠবাড়িয়ায় যাওয়ার একমাত্র সেই রাস্তাটি দেখে আঁেক উঠেছি। দানব সিডরের পায়ের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া রাস্তাটি এখনও সে রকমই পড়ে আছে। কর্তাব্যক্তিদের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এই প্রতিকূল আবহাওয়ার শিকার দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা আজও অবহেলায় পড়ে আছে। এরা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বোঝে না, জানে না যে তারা প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরণের শিকার, জানে না তারা যে অপেক্ষা করছে প্রকৃতির আরও নির্মম দিনগুলোর জন্য। কোটি কোটি টাকাও হয়তো বিদেশ থেকে আসবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ঠেকানোর জন্য বা ক্ষতিকে পুষিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু সবচেয়ে ডেঞ্জার জোনে বসবাস করা এই মানুষগুলোর তা কি কোনো কাজে আসবে?
এরই মধ্যে ডেনমার্ক কার্বন ক্রেডিট হিসেবে বাংলাদেশকে সাত লাখ ইউরো সাহায্য করবে বলেছে এবং তা নাকি ঢাকায় কয়েকটি ইটভাটা দূষণমুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হবে—এটি অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার উপকূলীয় জনগণের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।
লেখক : অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসালভেনিয়া, ইউএসএ

No comments

Powered by Blogger.