জয় হোক মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের by আতাউর রহমান

দিন, মাস, বছর চলে যায়; নতুন বছর আসে। এভাবে জগত্ ও জীবন চলছে আবহমান কালের চক্রে। পুরনো বিদায় নেয়, নতুন আসে। গাছের হলুদ পাতা যেমন ঝরে যায়, তেমনি আমরা বয়স্ক প্রিয়জনকে হারাই। পরিণত বয়সের আগেও অনেকেই এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয় অপঘাতজনিত মৃত্যুর কারণে অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে। এভাবে পৃথিবীর আহ্নিক গতি আর বার্ষিক গতির মতো জীবন আবর্তিত হচ্ছে।

আমরা সবাই জানি, এই হচ্ছে জীবনের হালচাল—মানুষের মৃত্যু হবে, নবজাতক আসবে। আমরা বিশ্ব চরাচরের নিয়মিত এই হালচালের কথা জানি, তবু আমরা নববর্ষের প্রতীক্ষায় থাকি। সবাই আশা করি, গত বছরের চেয়ে সামনের বছরটা ভালো যাবে। এর অর্থ আমরা বাঁচতে চাই, বেঁচে থাকাটাই যে আনন্দ। বেঁচে থাকাটা যদি মনোমত হয় তাহলে সেটা হয় জীবন নিয়ন্তার কাছ থেকে উপরি পাওনা। আমরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মাফিক চলি। আমাদের জীবনের পার্থিব হিসাব-নিকাশ, যাকে আমরা ইংরেজি দিনপঞ্জি বলি, সে অনুসারেই চলে। আজ সকালে হঠাত্ অজানা কারণে কমলকুমার মজুমদারের ‘গোলাপ সুন্দরী’ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। তার লেখা অত্যন্ত দুরূহ, দাঁত ফোটানো মুশকিল। আমি বহু কষ্ট করে জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ বহু পাঠের পর কিছুটা বুঝেছি। স্যামুয়েল বেকেট ও জাঁ পল সাঁর্তের লেখার ক্ষেত্রেও আমার অনুরূপ অবস্থা হয়েছে। যা পড়ে সহজে বুঝি না, তা না পড়লেই চলে, তবু জেদ চেপে যায় এই ভেবে যে, একজন মানুষ যা লিখেছে তা অন্য মানুষ কেন বুঝবে না! তার ওপর মানুষটা যদি হয় নামি ও দামি, তার লেখা বোধগম্য করে তোলার প্রয়াস প্রায় সব পাঠকের মনে কাজ করে। কমলকুমারের ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ অবশ্য পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। সিনেমাটা দেখেও প্রীত হয়েছিলাম। কমলকুমার মজুমদার এক অর্থে আজকের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গুরু; অতটা না হলেও তিনি কমলকুমারের বিরাট গুণগ্রাহী। সুনীলের কথায় ও লেখায় আমি তার এমত প্রকাশ লক্ষ্য করেছি। সুনীল নিজে কিন্তু কমলকুমারের স্টাইলের দিকে ধাবিত হননি। তার লেখা সহজ ও সুন্দর। তিনি বিরাট গল্প-কথকও বটে। তবে একটা কথা সত্য, বিজ্ঞানের কোনো ফর্মুলা মাথার চুল ছিঁড়ে পরিশেষে বুঝলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমনি দুরূহ লেখা বা চিত্রকর্মের মর্মার্থ বুঝতে পারলে চিত্ত পুলকিত হয়। আমি এই বোঝাকে দুই যোগ দুই=চার, এমনভাবে বোঝার সঙ্গে তুলনা করছি না। এই বোঝাটা বোধে ও অনুভবে হৃদয়ে তারের টঙ্কার তোলে, কখনও তরঙ্গের মতো হৃদয়কে প্লাবিতও করে। এভাবে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই জীবন থেকে আমরা নানাভাবে রস আহরণের প্রচেষ্টায় প্রবৃত্ত হই।
স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গড’ নাটকটি মঞ্চে আনার জন্য যখন আমি মহড়া করছি, তখন নাটকটিকে আবিষ্কারের আনন্দ আমাকে পেয়ে বসেছিল, আমি নাটকটির কাব্যসৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কমলকুমারের ‘গোলাপ সুন্দরী’ সম্পর্কে লিখেছেন—‘কাহিনীর চেয়েও বড় এর কাব্যসৌন্দর্য, কয়েকটি মাত্র চরিত্র তবু জীবনের কত দিক উদ্ভাসিত করেছেন লেখক, মৃত্যুকে দিয়েছেন মহান সংজ্ঞা।’ সুনীল যথার্থই বলেন, কমলকুমার মজুমদারের লেখা বার বার পড়তে হয়, বাংলা ভাষায় বার বার পড়ার মতো বড় একটা বই নেই। প্রতিবারই নতুন রসের সন্ধান পাওয়া যায়। অথচ কমলকুমার মজুমদারের মতো বড় লেখকও বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখকদের একজন নন। তিনি ফরাসি ভাষা খুব ভালো জানতেন। ধারণা করি, ফরাসি লেখার বাক্যবিন্যাসের ছাপ তার লেখায় পড়েছে। ফরাসিরা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসে, কমলকুমারের মধ্যে সেই প্রবণতা কাজ করেছে। আজ এই লেখা যখন লিখছি তখন ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৯। আগামীকাল থেকে শুরু হবে গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জির নতুন বছর। কমলকুমার মজুমদারের ‘গোলাপ সুন্দরী’র একটি এপিটাপের কথা আমার মনে পড়ে গেল। নিচে উদ্ধৃত হলো।
‘চল যাই—পর্বতের শৃঙ্গে, যেথা
পার্পাল কবরী বাঁধে
প্রত্যুষের প্রথম সূর্য,
তোমাদের শব্দ যেথা বর্ণ হয়ে যায়
সঙ্গীহীন ভালোবাসা
জেন অন্ধতায়—’
মৃত্যুর আগে মানুষ শিশু হয়ে যায়। সব পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে। শিশুকাল যেন মহানন্দে হামাগুড়ি দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খায়, এমনটা নাকি হয় মৃত্যুর আগে। তাহলে তো মৃত্যুকে ভয়ের কিছু নেই। মৃত্যুও তাহলে সুখের হতে পারে। তবুও আমরা পৃথিবীর মায়া কাটাতে পারি না। আজ দিবসের শেষ সূর্যের কাছে প্রাণ খুলে প্রার্থনা করতে ইচ্ছে করছে—আমাকে আরেকটি বছরের শেষ সূর্য দেখতে দাও। আমি শিশুকাল ফিরে চাই না, আমার প্রৌঢ়ত্বে আমি দুর্বাঘাসের আগায় লেগে থাকা শিশির বিন্দুটি দেখতে চাই। আমি মাচাঙ্গে ঝুলে থাকা কচি লাউটি দেখতে চাই, আমি শীতকালে পাঁচমিশালি মাছের সমারোহ দেখতে চাই, চিতোই ও ভাপা পিঠার ওপর থেকে উড়ন্ত ধোঁয়া দেখতে চাই। ‘গোলাপ সুন্দরী’র শেষটা এই রকম—‘বিলাসের নিশ্বাস দুর্ব্বল হইয়া আসিয়াছিল তথা আর কয়েকটি নিশ্বাস মাত্র সম্বল, এ কারণে দীর্ঘ নিশ্বাস তাহার ছিল না। শুধু, ইতিমধ্যে, সম্ভবত, মনে হইল মৃত্যুকে অমোঘ করিবার জন্য পুনরায় সে শিশু হইতেছে।’ নববর্ষে আমার কামনা—মৃত্যুকে অমোঘ না করে মৃত্যুকে জয় করতে চাই জীবন সাধনার সঞ্জীবনী সুধা দিয়ে। আমার পৃথিবী সুন্দর, আমার দেশ আদরিণী মা, আমার সংসার ও বন্ধু-বান্ধব হৃদয়বান, আমি ভালোবাসা পেয়েছি, জীবন-সুধা আকণ্ঠ পান করতে চেয়েছি এবং তৃপ্ত হয়েছি। অতৃপ্তি যদি থাকে কিছু সে আমারই অপারগতা। মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনের জয় হোক।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক

No comments

Powered by Blogger.